পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৭৬ প্রৰণসী $Nడి 88 যদি ধরা পড়েন, তাহা হইলে হয়ত দু-চারিট গালি শুনিতে হইবে—-গাটাও থাইতে হইতে পারে । সুতরাং ভয়ে ভয়ে তিনি সাধু হইলেন, অর্থাৎ সচল পয়সা দিয়াই বাসের টিকিট কিনিলেন । তখন বঁাকুড়া ও বৰ্দ্ধমানে অত্যস্ত দুভিক্ষ লাগিয়াছে । কোন এক মিশনের জনৈক গেরুয়াধারী সেবক বাসে উঠিলেন দুভিক্ষের সাহায্যের জন্য চাদ তুলিতে। তাহার হাতে একটি তাল-বন্ধ-করা কাঠের বাক্স, যাহার মাথায় একটি সরু ছিদ্র অাছে পয়সা গলাইবার জন্য। বাসে গান গাওয়া অসুবিধা, তাহ ন হইলে সেবকটি হয়ত “ভিক্ষা দাও গো...” ইত্যাদি বুক-কাপানো স্বরে গাহিতে স্বরু করিতেন । বাসের অভ্যস্তর এবং রাজপথ—এ দুয়ে অনেক তফাৎ। সুতরাং গেরুয়াধারী সেবক ভদ্রলোক গম্ভীর কণ্ঠে দুভিক্ষের ভীষণত] বর্ণনা করিয়া বাঙালীর কৰ্ত্তব্য সম্বন্ধে বকৃত করিতে লাগিলেন। কিন্তু বাঙালী জা’ত বক্তৃত৷ শুনিতে এত অভ্যস্ত যে বক্তৃত জিনিষটা বাঙালীর মনে বিশেষ কাজ করে না। কাজেই সেবকটির বক্তৃতা প্রথম কয়েক মিনিট ধরিয়া অরণ্যে রোদন অপেক্ষাও অনর্থক হইল, কেন-মা অরণ্যে রোদন করিলে বাঘ সিংহ হয়ত সাড়া দেয়, কিন্তু সেবকটির এই বাসে রোদনে বাসের কেহ সাড়া দিল না । বাক্স থালিত রহিল। কিন্তু ভীষণ দুর্ভিক্ষের ভীষণতর বর্ণনা শুনিয়া শ্রপতি বাবুর কোমল পরদুঃখকাতর হৃদয় আর ঠিক থাকিতে পারিল না। শপতিবাবু চোখে রুমাল চাপা দিয়া বালকের মত কঁাদিয়া উঠিয়া কহিলেন, “বলেন কি মশায় ? এমন শোচনীয় অবস্থা ? অনাহারে শুকিয়ে মরছে মাতুষ সেখানে ? ছেলের মুখের গ্রাস মা কেড়ে নিচ্ছে ? উঃ, খামুন মশায়—আর যে সক্টতে পারি নে “ শ্ৰীপতি বাৰু উচ্ছসিত ভাবে কাদিয়া উঠিলেন। র্তাহার এই কান্নায় সেবকটি অত্যন্ত উৎসাহিত হক্টলেন । তিনি কোনদিকে কিছু সুবিধা করিতে ন পারিয়া অগত্য সেবকঞ্জীবন অবলম্বন করিয়াছিলেন—সে অনেক দিনের কথা । এই দীর্ঘ সেবকঞ্জীবনে এরূপ সাফল্যের আনন্দময় অভিজ্ঞতা তিনি আর কখনও লাভ করেন নাই । আনন্দে তাহারও দুটি চোখ সঙ্গল হইয়া উঠিল। তিনি দুর্ভিক্ষের অসহ কাহিনী আরও অসহ্ করিয়া তুলিবার জন্ত দ্বিগুণ উৎসাহে বক্তৃত স্বরু করিলেন । “ওঃ ! এত কষ্টও ভগবান দেন মানুষকে ?” কঁদকাদ কণ্ঠে শ্ৰীপতিবাৰু বলিতে লাগিলেন, “আমাদেরই বাংলা দেশের লোক দারুণ দুর্ভিক্ষে হাহাকার ক’রে র্কাদছে, আর আমরা কিনা দিব্বি—-ও !” শ্ৰীপতিবাবু আবার কাদিয়া বেসামাল হইয়ু পড়িলেন । দেশবাসীর দুঃথে শ্রপতি বাবুর এরূপ অসাধারণ সমবেদন দেখিয়া বাসের সকলেই নিজেদের ঔদাসীন্যের কথা ভাবিয়া লজ্জিত হইয় পড়িলেন । কেহ কেহ কাদিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন, কিন্তু "চেষ্টার অসাধ্য কিছু নাই” এ কথাটা অনেকে বলিলেও কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। চেষ্টা করিলেই সবাই কাদিয়া ভাসাইতে পারে না। অনেক কষ্টে নিজেকে একটু সামলাইয়া লইয়া শ্রপতি বাবু কহিলেন, “বাংলার ভাইদের, মা-বোনদের এত দুঃখদুৰ্দ্দশার কাহিনী শুনেও যারা এ বিষয়ে উদাসীন থাকতে পারে ধিক্ তাদের জীবনে - “ বলিয়া পকেট হইতে সেই সিকিট বাহির করিলেন । “সঙ্গে তো বিশেষ কিছু নেই। বাসভাড়া দিয়ে মাত্তোর এই সিকিটা আছে । তাই দিই এখন।” বলিয়াই যেন সবাহ সিকিট দেখিতে পায় এইভাবে, ঝট, করিয়া বাক্সের ভিতর গলাইয়া দিলেন । একটা পয়সা নয়, দুটা পয়সা নয়—একেবারে একটা সিকি ! এই অপূৰ্ব্ব বদান্যতা দেখিয়া বাসের সবাহ, এবং বাক্সওয়াল গেরুয়াবিলাসী সেবক ভদ্রলোকটি অবাক হইয় গেলেন । পরে যখন "সেই জীবনে ধিক কথাটার একবার পুনরাবৃত্তি করিয়া দুর্ভিক্ষপীড়িতদের দুর্দশার কথা ভাবিয়া চোথে রুমাল চাপিয়া শ্রপতিবাবু ফুলিয়া ফুলিয়া কাদিয়া উঠিতে লাগিলেন, তখন আত্মসম্মান রক্ষার জন্য এবং ধিক্কারের হাত হইতে জীবন বঁাচাইবার জন্য সকলে ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন । সিকি, আধুলি, ছানি ইত্যাদিতে বাল্পটি দেখিতে দেখিতে ভরিয়া উঠিল ।. বাস হইতে নামিয়া বাড়ীর দিকে চলিতে চলিতে শ্ৰীপতিবাবু ভাবিলেন, “যাক্‌-অচল সিকিট একটা মহৎ কাজে লাগল।”