পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আশষণঢ় আসিলে আমার বন্ধুরা অনেকে আমাকে চিনিতে পারেন নাই । যথারীতি টিকিট দিয়া এবং মালপত্র লইয়া ষ্টেশনের বাহিরে আসিলাম। বাহিরে গাড়ী অপেক্ষা করিতেছিল ;– অবিলম্বে বাড়ী পৌছিলাম, এবং সকাল সকাল আহার সারিয়া গুইয়া পড়িলাম। দীর্ঘকাল রাত্রি জাগরণের পর, মায়ের স্বত্বস্তু-প্রস্তুত বিছানায় একান্ত নিশ্চিস্ত মনে নিদ্রা গেলাম । অঙ্ক দেশের সহিত এই আমার প্রথম পরিচয় । পরিচয়ট পাকা করিয়া লইবার জন্তু পরদিন সকালে বাহির হইলাম । রাস্তায় পা দিয়াই মনে পড়িল,—এ বাংলা দেশ নয় । শুধু তাই নয়, এই দক্ষিণ দেশের দ্রাবিড় সভ্যতা উত্তরা পথের আর্য্য ( ) সভ্যতা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক । বেশ মোটা—এবং সেই জন্য দেখিতে বেঁটে—অগণিত মহিল| চলিয়াছেন ; মাথায় অবগুণ্ঠন নাই ; গতিভঙ্গী দুপ্ত ও অকুষ্টিত। মনে হইতেছে রবিবৰ্ম্মার অঙ্কিত পৌরাণিক চিত্রের ভিতর হইতে এইমাত্র বাহির হইয়া আসিলেন । তাহাজের অসংখ্য প্রকার বিভিন্ন রঙের শাড়ী ও চাদরের প্রভায় পথ রঙীন ও উজ্জল হইয়া উঠিয়াছে ।--এই বর্ণবৈচিত্র্যময় দক্ষিণ দেশের সহিত বাংলা দেশের তুলনা করিয়া মনে আঘাত পাইলাম। বাঙালীর জীবনে সহজ আনন্দের অভাব ঘটিয়াছে । চোথ ভরিয়া এই রঙের লীলা দেখিতে লাগিলাম । নীল আকাশ হইতে সোনালী রোদ ঝরিয়া পড়িতেছে । --বেগুনী পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট শহরটি। লাল টালির ছাদ-দেওয়া ছোট ছোট জানালাবিহীন বাড়ী, সরু সরু রাস্ত,--আর চারিদিকে—রঙ—রঙ—রঙ। সবুজ, নীল, হলদে, ফিরোজ, কমলা, লাল-যত রকম রঙ কল্পনা করা যায়—এই সবরকম রঙের ওড়না বাতাসে উড়িতেছে। কালে রঙের অথবা রক্তবর্ণের শাড়ীর রূপালী জরির পাড় হইতে, মহিলাদের হাতের সুবর্ণ-কঙ্কণ ও কোমরের চওড়া সোনার বেণ্ট হইতে স্বর্ঘ্যের কিরণ ঠিকরাইতেছে।...চমৎকার ! কিন্তু ভাবুকতা বেশীক্ষণ রহিল না। বিরক্ত कt? भ বলিলেন—“ম গে, ই ক’রে দেখছে দ্যাথোঁ । কেন ধে বাপু, আমরা চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে এলাম না कि ?” কথাটা ঠিক। আমরা উহাদের যতটা আশ্চধ্য হইয়। দেখিতাম,—উহারা তার চেয়ে ঢের বেশী আশ্চৰ্য্য হইয়া আমাদের দিকে চাহিয়া থাকিত। বেচারীদের দোষ নাই । উহার বাঙালীর নাম বহুৎ শুনিয়াছে, কিন্তু চাস্থ্য পরিচয় বেশী পায় নাই। অন্ধ, দেশ 8た● এক জায়গায় দেখিলাম, অন্ধ-মহিলার পথে কল তলায় স্নান করিয়া জল লইয়! যাইতেছেন । কোমরে হাত দিয়া দিব্য সাবলীল ভঙ্গীতে প্রকাগু ঘড়ায় করিয়া জল লইয় চলিয়াছেন । বঙ্গ-মহিলার কাথে কলসী লইয়। ধীর মরালগমন মহে । কাধে ঘড়ী বসাইয়া, কোনও দিকে দৃকপাত না করিয়া, দৃপ্ত-অকুষ্টিত মুনীর গতিভঙ্গী। চোখে ইহা অপরূপ ঠেকিল ; মনে মনে সংশয় জন্মিল,—হয়ত ইহাদের ভাষায় 'অবলা’ শব্দটা নাই । অবশু, নিঃসংশয়ও হইয়াছিলাম ; কিন্তু অনেক দিন পরে। একটু অবাস্তর হইলেও, ঘটনাটি এখানে বলিতেছি । আমি তখন পিতৃদেবের অধীনে অ্যাসিষ্ট্যাণ্ট ইলেকটি ক্যাল ইঞ্জিনীয়ার নিযুক্ত হইয়াছি। রাস্তায় লাইন-মার্ক করিতে বাহির হইয়াছি ; এবং সমস্ত সকালটা খাটিয়া, অনেকগুলা ঝাণ্ড পুতিয়া একটা দীর্ঘ লাইন রেঞ্জ’ করিয়াছি। কাজ প্রায় শেষ করিয়া আনিয়াছি ; মনে করিতেছি, এই বারে ঝাণ্ডাগুল তুলিয়। খোটা বসাইয়া চলিয়া যাইব । কিন্তু বিপত্তি ঘটিল। পল্লীস্থ একটা বালক আসিয়া, হঠাৎ কি মনে করিয়া একটা ঝাও তুলিয়া লইয়। প্রস্থান করিল। আমার সঙ্গের এক জন অ্যাপ্রেটিসের ইহাতে ধৈৰ্যচুতি ঘটিল। সে ছুটিয়া গিয়া ছেলেটার দুই গালে চপেটাঘাত করিল । ফল ফলিতে দেরী হইল না। ছেলেটার গগনভেদী চীংকারের সঙ্গে সঙ্গে চারি দিক হইতে অসংখ্য মহিল, এবং কয়েকটি পুরুষ ছুটিয়া আসিলেন ; এবং আমাদেরই ঝাণ্ডাগুলি তুলিয়া লইয়া বিনা বাক্যব্যয়ে আমাদের পিটিতে স্বরু করিলেন । আমার দলে পাচ জন কুলি, চার জন আপ্রেটিস এবং আমি নিজে ছিলাম। কিন্তু পাছে স্ত্রীলোকের গায়ে হাত লাগে, এই ভয়ে তাহাদের দলের পুরুষদেরও মারিতে পাবিলাম না । আমি হিন্দীতে, ইংরেজীতে এবং অবশেষে বাংলায় তাহাদের ব্যাপারটা বুঝাইবার প্রয়াস পাইলাম, কিন্তু তাহার সে সকল কিছুই বুঝিতে পারিল না ; এবং সম্ভবত: সেই আক্রোশেই আরও বেশী করিয়া পিটিতে স্বরু করিল। অতএব দাড়াইয়ু মাৱ ত খাইলামই ; উপরস্তু প্ল্যান, কাগজপত্র ইত্যাদি ছিড়িয়া হারাইয়া গেল। নিরুপায় ! এই ব্যাপারে সব চেয়ে মজার কাও করিয়াছিল, আলোর নামে একটি অ্যাসিষ্ট্যান্ট। এই ছেলেটি তামিল ; অতএব অন্ধ দেশে এণ্ড আমার মত বিদেশী। মারামারির প্রারম্ভেই ইহাকে আমি সাইকেলে পিতৃদেবের নিকট খবর দিতে পাঠাইয়াছিলাম। কিন্তু মারামারি খামিয় গেলেও যখন তিনি আসিয়া পৌছিলেন না, তখন খুব আশ্চৰ্য্য হইয়াছিলাম। কারণটা পরে জানিলাম।