পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মাটির বাসা ঐসীতা দেবী (w) ভোরের আলো ক্রমেই উজ্জ্বলতর হইয় উঠতেছে। কুয়াসার স্বচ্ছ আবরণ একেবারে অপসারিত হয় নাই, তবে হহারই-ফাকে ফঁাকে আলোর অঞ্জলি চারিদিকে ঝরিয়া পড়িতেছে। ছেলেমেয়ের ঠেলাঠেলি মারামারি বাধাইয়া দিয়াছে রোদ পোহাইবার জন্য। ঘুম ভাঙিলে পাড়াগায়ের ছেলেমেয়ে আর বিছানায় গুইয়া ঝিমাইতে চায় না, তখনই উঠিয়া পড়ে। তাহাদের দামী শীতবস্ত্রের বালাইও বেশী নাই, কাখ মুড়ি দিতে আরাম লাগে বটে, কিন্তু শীতের হাওয়া যখন খোলা মাঠের উপর দিয়া হু হু করিয়া ছুটিয়া যায়, তখন এই জীর্ণ বস্ত্রের বৰ্ম্মের সাধ্য কি যে তাহাকে ঠেকাইয়া রাখে । ছেলেমেয়েদের হাড়ে হাড়ে কাপুনি ধরিয়া যায়। তখন রোদটুকুতে পিঠ পাতিয়া বসা ছাড়া উপায় কি ? অতএব চিনি একখানা বড় পিড়ি পাতিয়া তাহার উপর উবু হইয়া বসিয়া আছে। সে চালাক মেয়ে, আগেভাগে ভাল জায়গাটুকু দখল করিয়া বসিয়া আছে। টিনি তত ভাল জায়গা পায় নাই, তাহাকে পিড়ি পাতিতে হইয়াছে একেবারে দাওয়ার সিড়ি ঘেষিয়া, বেশী নড়াচড়া করিতে গেলে গড়াইয়ু উঠানে পড়িয়া যাওয়া অনিবার্ষ্য। তাই নিজের জায়গায় বসিয়াই দুই-একটা ঠেলা দিয়া সে দেখিতেছে, যে, চিনিকে তাহার সীমানা হইতে একটু হঠাইয় দেওয়া যায় কি না। তবে এখন পৰ্য্যস্ত চিনি সদৰ্পে নিজের রাজ্য রক্ষা করিতেছে, একচুলও নড়ে নাই। তিনজনের মধ্যে কামুই আছে ভাল, এত সকালেই ত তাহাকে খাটের খুরার সঙ্গে বাধা যায় না, তাই তাহার মা তাহাকে কোলে লইয়াই রান্না করিতে বসিয়াছেন। আর একটু বেলা না হওয়া পৰ্য্যস্ত সে সেখানেই থাকিবে । শীতের ভোরে রান্নাঘরের মত আরামদায়ক জায়গা আর আছে কোথায় ? কিন্তু মা বড় একচোখো, চিনি টিনিকে তিনি রামান্বয়ের ধারেকাছেও ঘেষিতে দেন না। তাহারা নাকি অতি নোংরা, তাহাদের কাপড়চোপড় বাসি । মৃণাল ইহারই মধ্যে স্নান করিয়া ফেলিয়াছে, শীতের বাধা মানে নাই। এখানে গরম জলে স্নান করার নিয়ম নাই, যতই শীত হউক, খোলা পুকুর-ঘাটে, কনকনে ঠাণ্ড৷ জলেই স্বান করিতে হইলে । এইসব সময় মনে হয়, কলিকাতায় থাকিয়া আরাম আছে বটে, এক-একদিকে । চক্ষু, কর্ণ, মন সেখানে সারাক্ষণই পীড়িত হয়, কিন্তু শরীরটা আরাম পায়। ইচ্ছা ন হয়, তুমি চব্বিশ ঘণ্ট। খাট হইতে না নামিয়াই কাটাইয়া দিতে পার, সব-কিছুর ব্যবস্থাই হাতের কাছে পাওয়া যায়। মামীম কিন্তু শহরে যাহা-কিছু সমস্তেরই বিরোধী, বলেন, “মা গো মা, কি কাও ! গা ধিন্‌ ধিন্‌ করে না গা ? শোবার ঘরের পাশে ও সব কি ? কে জানে বাপু, আমরা পাড়াগেয়ে মানুষ ও সব ভাল বুঝি না। তোর দিদিমা বেঁচে থাকলে অমন বাড়ীর চৌকাঠ মাড়াতে দিতেন না তোকে, যা বিচার ছিল তার ।" মুণাল হাসে, কিন্তু মনে মনে মামীমার কথা স্বীকার করে না। এত বৎসর কলিকাতায় থাকিয়া ত সে দেখিল ? সত্যই আরাম এখানে পাওয়া যায়, যদি টাকা খরচ করিবার ক্ষমতা থাকে। গরীবের পক্ষে অবগু কলিকাতা নরকতুল্য। বিনা পয়সায় এখানে কিছুই পাওয়া যায় না, আলো না, বাতাস না, আকাশের দিকে তাকাইবার অধিকার পর্য্যস্ত ন! । পল্পীজননীর কোল সত্যই মায়ের কোল, এখানে ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ তত উগ্র নয়। এখানে ভগবানের দেওয়া আলো-বাতাস হইতে কেহই বঞ্চিত নয়, খোলা আকাশের নীচে খোলা মাঠের বুকে বেড়াইবার অধিকার সকলেরই সমান। সকাল-সন্ধ্যায় কত যে বিচিত্র শোভার ভাণ্ডার চারিদিকে উন্মুক্ত হয়, তাহ