পাতা:প্রবাসী (সপ্তবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૨૭ প্রবাসী-জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৪ [ ২৭শ ভাগ, ১ম খ ও হইতে ভ্ৰষ্ট হইল এবং তাহার শ্রেষ্ঠ সম্রাট মহর্ষি অশোকের বাণী বিস্মরণের অন্ধকারে বিলীন হইয়া গেল । সেইদিন হইতে পরাজয় ও পরাধীনতা ভারতবর্ষে দুৰ্গতিকেই বহন করিয়া আনিয়াছে ; তখন হইতেই আমাদের দুঃখদুর্ভাগ্য একান্ত হইয়া দেখা দিয়াছে। যে আত্মার শক্তিতে ভারতবর্ষ একদিন দুঃখ দুর্ভাগ্যকেও কল্যাণপ্রদ করিয়া তুলিতে সমর্থ হইয়াছিল, তারতবর্ষ আর-এক দিন সেই শক্তিকেই হারাইয়া বসিল । তাই তাহার নিজের সামাজিক বিধানও উদ্বন্ধনের নিগড়রূপেই আত্ম-প্রকাশ করিল ; তাহার ধৰ্ম্মবিধান তাহাকে অধৰ্ম্মের অন্ধকারের দিকেই পথ নির্দেশ করিল ; এবং সেইজন্যই বৈদেশিক বিজেতার বিজয়ধ্বনি ভারতবর্ষের পথে প্রাস্তরে মৃত্যুর প্রলয়শখের মতই শোনা গেল। তাই মহম্মদ বিন কাশিম, স্বলতান মামুদ, মহম্মদ ঘোরী, মহম্মদ খিলজি প্রভৃতির ভারত-বিজয়-কাহিনী আমাদের জন্য এত লজ, এত অপমান ও এত লাঞ্ছনা সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছে। যেদিন এইসব বিজেতা ভারতবর্ষে দেখা দিল, সেদিন ভারতবর্ষের আত্মা হীনবল, তাহার বাণী বিশ্বত ও তাহার আদর্শ বিকৃত হইয়া গিয়াছিল । তাই সেদিন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যথার্থ "ধৰ্ম্ম-সম্বন্ধ" স্থাপিত হইতে পারে নাই এষং সেইজস্যই এই উভয়ের সম্পর্কের মধ্যে এতখানি বেদন ও এতখানি অপমান নিহিত ছিল। আজও আমাদের সেই বেদন ও সেই অপমানের অবসান হয় নাই । কারণ আমাদের মধ্যে এখন আর সেই “ধর্মের দীপনা” নাই ; সেই ধৰ্ম্মদান ও ধৰ্ম্মবিজয়ের আকাজক্ষ আমরা হারাইয়া ফেলিয়াছি। আমরা আজ নিজেদের মধ্যেই যথার্থ ধৰ্ম্ম-সম্বন্ধ রক্ষা করিতে পারিতেছি না। আর সেইজন্যই ভারতবর্ষের যাহা প্রকৃত স্বারাজ্য তাহাও আজ আমাদের কাছে দুল্লভ হইয়াই রহিয়াছে। ভারতবর্ষ যে বৈদেশিকের পশুশক্তি বা অস্ত্রশক্তির নিকট পরাভূত হইয়াছে ইহাই দুঃখের বিষয় নহে । ভারতবর্ষ যে অস্ত্রশক্তির উপরেও আত্মার শক্তিকে জয়ী করিয়া রাখিবার অপূৰ্ব্ব ক্ষমতা হারাইয়া ফেলিয়াছে, তাহাই দুঃখের বিষয় । বাহির হইতে যে অধীনতা আমাদের উপর চাপিয়া বসিয়াছে তাঁহাই আমাদের অন্তরকে ব্যথিত করিতেছে না। আমাদের বেদনার মূল কারণ, আমরা আর আমাদের চিত্তের স্বাধীনতা দ্বারা বাহিরের গ্লানিকে মুছিয়। ফেলিতে পারিতেছি না, ষাহিরের অধীনতাকে চিত্তের প্রবল অস্বীকারের দ্বারা বিলুপ্ত করিয়া দিতে পারিতেছি না। আমাদের আত্মা বলহীন হইয়া পড়িয়াছে, তাই বাহিরের অধীনতাকে স্বীকার করিতে বাধ্য হইতেছি । আমরা আজ পরের হাত হইতে অধীনতাকে পাইয়াছি, ইহাই সত্য কথা নহে । সত্য কথা এই যে, আজ আমরা আমাদের অস্তর হইতে যথার্থ স্বাধীনতাকে হারাইয়। ফেলিয়াছি, আমরা আজ আমাদের মহামুক্তির বাণীকেই বিশ্বত হইয়। গিয়াছি। ভারতবর্ষকে আবার স্বাধীনতা লাভ করিতেই হইবে। কিন্তু কেবল অন্ধ আক্ৰোশে বাহিরের নিগড়টাকে আঘাত করিতে থাকাই সে স্বাধীনতা-লাভের প্রশস্ত উপায় নহে। চিত্তকে মুক্তি দান করাই বাহ মুক্তি লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় । কারণ, অধীনতা মাত্রই মোহ বা মায়া । আর আঘাতের দ্বারাই মায়ার বন্ধন ছেদন করা যায় না, সে বন্ধন ছেদন করার একমাত্র অস্ত্র জ্ঞান, চিত্তের উদ্বোধন । আমরা যদি আজ অস্তরের ভিতর হইতে স্বাধীনতাকে লাভ করিবার সাধন না করিয়৷ পরাধীনতাকে দূর করিবার তীব্ৰ কামনায় কেবল পরকে আঘাত করিতে থাকি, তবে বাহিরের নিগড় বতই ছিন্ন হোক না কেন আমরা উর্ণনাভের মত বারে বারেই আমাদের বন্ধনজাল নিজেরাই রচনা করিতে থাকিব ।