পাতা:প্রবাসী (সপ্তবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(లిa প্রবাসী—শ্রোবণ, ১৩৩৪ [ ২৭শ ভাগ, ১ম খণ্ড রাখিতেন, তখন হইতে প্রতিমাতে আর প্রতিমা-বুদ্ধি থাকিত না। পূজার ক'দিন এ যে মাটির পুতুল, কিছুতেই ইহ ভাবিতাম না। নবমী দিন সন্ধ্যা-আরতির সময় মনে হইত, যেন বিজয়ার আসন্ন-বিরহ ভাবিয়া দেবী বাস্তবিক কাঞ্জিতেছেন। বিজয়ার সন্ধ্যার পরে প্রতিমা বিসর্জন দিয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিলে প্রাণে ঘোর অবসাদ আসিত । এখন, মনস্তত্বের দিক দিয়া, এ অবসাদ কেন হয়, তাহা বুঝি। তিন দিনের নিরবচ্ছিন্ন উল্লাস ও উৎসাহের পরে উৎসবের অবসানে, এ প্রতিক্রিয়। অপরিহার্য্য। কিন্তু বাল্যে এ জ্ঞান হয় নাই, হওয়ার কথাও ছিল না । স্বপ্তরাং বিজয়ার অবসাদ যে দেবতার বিরহ হইতে হয় নাই, ইহা বুঝিতাম না। তখনও দেবতায় বিশ্বাস ছিল, তবে এ দেবতা যে কি বস্তু এ প্রশ্নই মনে কখনও উঠে নাই । দেবতা মাতুর্যের মতনই, অথচ মাস্থ্য নহেন, এতটুকু ধারণা হইয়াছিল। এইসকল পারিবারিক পূজাপাৰ্ব্বণের ভিতর দিয়া যাকিছু ধৰ্ম্মশিক্ষা লাভ হইয়াছিল। এ শিক্ষা মতের শিক্ষা ছিল না, ভাবের শিক্ষা এবং অনুভূতির শিক্ষাই ছিল। প্রথম যৌবন পৰ্য্যন্ত ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে ইহার অপেক্ষ বেশী কিছু বোধ জন্মে নাই ; তার পরেও জন্মিয়াছে কি না, সাহস করিয়া এ কথা বলিতে পারি না। এইসকল পূজাপাৰ্ব্বণের ভিতর দিয়া অতি-প্রাকৃতে বিশ্বাস সাধন করিয়াছিলাম। এই সাধনই ধৰ্ম্মসাধনের গোড়ার কথা। আমরা চোথে যাহা দেখি, কাণে যাহা শুনি, এসকল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যাহা গ্রহণ করি, তাহার অতীতেও যে-বস্তু আছে, ইহাই ধৰ্ম্মসাধনের বুনিয়াদ । প্রাচীন হিন্দু-সমাজে প্রচলিত পূজাপাৰ্ব্বণের ভিতর দিয়া ধৰ্ম্মজীবনের এই ভিত্তি গঁথা হইয়াছিল, এ কথা অস্বীকার করিতে পারি না । আর এইজন্যই নিজে যে-সকল পূজাপাৰ্ব্বণ বর্জন করিয়াও আমার মা-বাবা যে-সকল পূজা করিতেন, তাহা যে পাপকাৰ্য্য, এ অপরাধের কথা কখন কল্পনাও করি নাই। আমার পক্ষে এখন এসকল পূজার অনুষ্ঠান পাপ হইতে পারে ; পাপ হইবে, মিথ্য আচরণ বলিয়া, যাহা আমি বিশ্বাস করি না তাহার ভাণ করিব বলিয়া ; কিন্তু আমার পিতৃ-মাতৃকুঙ্গের গুরুজনের ঐ সকল প্রতিমাপূজাতে ষে পাপাচরণ করিডেন, ইহা কিছুতেই মনে করিতে পারি | || - আমাদের শ্রীহট্টের বাসায়ও প্রায় সৰ্ব্বদাই ব্ৰত-পূজা প্রভৃতি হইত। প্রতি শনিবারে শনির সেবা হইত। ম। প্রতি মঙ্গলবারে মঙ্গলচণ্ডীর ব্ৰত করিতেন। এছাড়া জ্যৈষ্ঠ মাসে ম সাবিত্রীর ব্রত করিতেন। সারা মাঘমাস প্রতি রবিবারে সুৰ্য্যের ব্রত করিতেন। এসকল ব্রতের "কথা” মায়ের কাছে বসিয়া আমিও শুনিতাম । আর ব্রডশেষে প্রসাদের ভাগ ত পাইতামই । ఇ& শ্রীহট্ট সহরে মাঝে মাঝে যাত্রাগান হইত। আমাদের বাসাতেও হইত, প্রতিবাসীদের বাড়ীতেও হইত। আমি প্রায় সৰ্ব্বশ্নই এসকল যাত্রা শুনিতে যাইতাম । আমার বাল্যকালে রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক যাত্রা ব্যতীত রাম-ষনবাস, নিমাই-সন্ন্যাস প্রভৃতি যাত্রীও হইত। কিন্তু আমাদের বাসায় মা কিছুতেই নিমাই-সন্ন্যাস বা রাম-বনবাসের পালা হইতে দিতেন না। আমি তার একমাত্র পুত্র, বোধ হয় এইজন্যই রামের বনবাস বা নিমাইয়ের সন্ন্যাসের কথা শুনিতে র্তাহার প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিত। কৃষ্ণ যাত্রার মধ্যে ঢাকার ৬/কৃষ্ণকমল গোস্বামী মহাশয়ের ‘স্বপ্নবিলাস, রাই-উন্মাদিনী’ এবং ‘বিচিত্র বিলাস’---এই তিনটি পালার কথাই বিশেষ মনে আছে। এসকল পালা মহাজন-পদাবলীর অতুকরণে রচিত। অনেক সময় গোস্বামী মহাশয়, বোধ হয়, তাহার সঙ্গীতে প্রাচীন পদ যোজনা করিয়া দিতেন। রসের অনুভূতিতে এসকল পদ মহাজন-পদাবলী অপেক্ষ নিকৃষ্ট ছিল না । শ্রীহট্ট সহরে সেকালে মাঝে মাঝে ভদ্রলোকদিগের বাসায় পুরাণ-পাঠও হইত। কিন্তু এই পুরাণ-পাঠে কোন প্রকারের লোকশিক্ষা হইত না। অনেক স্থলে একখান পুথি জলচৌকির উপরে রাখা হইত। আর তাহারই সম্মুখে থালা বা রেকর্ণধী থাকিত। আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা এই নিমন্ত্রণ রক্ষ করিতে আসিয়া ঐ বাধা পুথিকে প্রণাম করিয়া ঐ খালার উপরে নিজেদের প্রণামী রাখিয়া দিতেন। এই পুরাণপাঠট অনেক সময় গৃহস্থের পুরোহিত বা গুরুঠাকুরের জন্ত কিঞ্চিৎ অর্থসংগ্রহের একটা উপায় মাত্র ছিল।