পাতা:প্রবাসী (সপ্তম ভাগ, দ্বিতীয়াংশ).djvu/৩০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

করিয়া তোলে। তাহ না করিয়া যেখানে মানুষকে উদ্ধত ও অহঙ্কত করে সেখানে মানুষ আপনার ক্ষুদ্রতাকে সেই সত্যের তুলনাতেই অত্যন্ত সুস্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করে। এইখানে পরেশ বাবুর সঙ্গে হারাণের প্রভেদ সুচরিতা মনে মনে আলোচনা না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরেশ বাবু ব্রাহ্মসমাজের নিকট হইতে যাহা লাভ করিয়াছেন তাহার সম্মুখে তাহার মাথা যেন সৰ্ব্বদা নত হইয়া আছে— সে সম্বন্ধে তাহার লেশমাত্ৰ প্ৰগলভূত নাই—তাহার গভীরতার মধ্যে তিনি নিজের জীবনকে তলাইয়া দিয়াছেন। পরেশ বাবুর শাস্ত মুখচ্ছবি দেখিলে, তিনি যে সত্যকে হৃদয়ে বহন করিতেছেন তাহারই মহত্ত্ব চোখে পড়ে। কিন্তু হারাণ বাবুর সেরূপ নহে—র্তাহার ব্রাহ্মত্ব বলিয়া একটা উগ্র আত্মপ্রকাশ অন্য সমস্ত আচ্ছন্ন করিয়া তাহার সমস্ত কথায় ও কাজে অশোভনরূপে বাহির হইয়া থাকে। ইহাতে সম্প্রদায়ের কাছে তাহার আদর বাড়িয়া ছিল কিন্তু স্বচরিতা পরেশের শিক্ষাগুণে সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ হইতে পায় নাই বলিয়া হারাণ বাবুর একান্ত ব্রান্ধিকতা সুচরিতার স্বাভাবিক মানবত্বকে যেন পীড়া দিত। হারাণ বাবু মনে করিতেন, ধৰ্ম্মসাধনার ফলে তাহার দৃষ্টিশক্তি এমন আশ্চৰ্য্য স্বচ্ছ হইয়াছে যে, অন্ত সকল লোকেরই ভালমন্দ ও সত্যাসত্য তিনি অতি অনায়াসেই বুঝিতে পারেন। এই জন্ত সকলকেই তিনি সৰ্ব্বদাই বিচার করিতে উষ্ঠত। বিষয়ী লোকেরাও পরনিন্দ পরচর্চা করিয়া থাকে কিন্তু যাহারা ধাৰ্ম্মিকতার ভাষায় এই কাজ করে তাহাদের সেই নিন্দার সঙ্গে আধ্যাত্মিক অহঙ্কার মিশ্রিত হইয়া সংসারে একটা অত্যন্ত স্বতীব্র উপদ্রবের সৃষ্টি করে। সুচরিতা তাহা একেবারেই সহিতে পারিত না। ব্রাহ্মসম্প্রদায় সম্বন্ধে সুচরিতার মনে যে কোনো গৰ্ব্ব ছিল না তাহা মহে তথাপি ব্ৰাহ্মসমাজের মধ্যে র্যাহার বড় লোক র্তাহারা যে ব্রাহ্ম হওয়ারই দরুণ বিশেষ একটা শক্তিলাভ করিয়া বড় হইয়াছেন এবং ব্রাহ্মসমাজের বাহিরে যাহারা চরিত্রভ্রষ্ট তাহারা যে ব্রাহ্ম না হওয়ারই কারণে বিশেষভাবে শক্তিহীন হইয়া নষ্ট হইয়াছে এ কথা লইয়া হারাণ বাবুর সঙ্গে স্বচরিতার অনেকবার তর্ক হইয়া গিয়াছে। হারাণ বাবু ব্রাহ্মসমাজের মঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য করিয়া যখন বিচারে পরেশ বাবুকেও অপরাধী করিতে ছাড়িতেন না তখনই স্নচরিতা যেন আহত, ফণিনীর মত অসহিষ্ণু হইয়া উঠিত। সে সময়ে বাংলাদেশে ইংরাজিশিক্ষিতদলের মধ্যে ভগবদগীতা লইয়া আলোচনা ছিল না। কিন্তু পরেশ বাবু স্বচরিতাকে লইয়া মাঝে মাঝে গীত পড়িতেন -—কালিসিংহের মহাভারতও তিনি প্রায় সমস্তটা সুচরিতাকে পড়িয়া শুনাইয়াছেন। হারাণ বাবুর কাছে তাহ ভাল লাগে নাই। এ সমস্ত গ্রন্থ তিনি ব্রাহ্মপরিবার হইতে নির্বাসিত করিবার পক্ষপাতী। তিনি নিজেও এগুলি পড়েন নাই। রামায়ণ মহাভারত ভগবদগীতাকে তিনি হিন্দুদের সামগ্ৰী বলিয়া স্বতন্ত্র রাখিতে চাহিতেন। ধৰ্ম্মশাস্ত্রের মধ্যে বাইবৃলই তাহার একমাত্র অবলম্বন ছিল। পরেশ বাবু যে তাহার শাস্ত্রচর্চা এবং ছোটখাটো নানা বিষয়ে ব্রাহ্ম অব্রাহ্মের সীমা রক্ষণ করিয়া চলিতেন না তাহাতে হারাণের গায়ে যেন কঁাটা বিধিত। পরেশের আচরণে প্রকাস্তে বা মনে মনে কেহ কোনো প্রকার দোষারোপ করিবে এমন স্পৰ্দ্ধা সুচরিত কখনই সহিতে পারে না । এবং এইরূপ স্পৰ্দ্ধা প্রকাশ হইয় পড়াতেই হারাণ সুচরিতার কাছে খাটো হইয়া গেছেন। এইরূপ নানা কারণে হারাণবাবু পরেশবাবুর ঘরে দিনে দিনে নিম্প্রভ হওয়া আসিতেছেন। বরদাসুন্দরীও যদিচ ব্রাহ্ম অব্রান্ধের ভেদ রক্ষায় হারাণবাবুর অপেক্ষা কোনো অংশে কম উৎসাহী নহেন এবং তিনিও তাহার স্বামীর আচরণে অনেক সময়ে লজ্জা বোধ করিয়া থাকেন তথাপি হারাণবাবুকে তিনি আদর্শ পুরুষ বলিয়া জ্ঞান করিতেন না। হারাণবাবুর সহস্ৰ দোষ তাহার চোখে পড়িত। তাহার প্রধান ও প্রথম কারণটা সম্বন্ধে আমরা পূৰ্ব্বেই আভাস দিয়াছি। হারাণবাবুর সাম্প্রদায়িক উৎসাহের অত্যাচারে এবং সঙ্কীর্ণ নীরস হায় যদিও সুচরিতার মন ভিতরে ভিতরে প্রতিদিন তাহার উপর হইতে বিমুখ হইতেছিল তথাপি হারাণবাবুর সঙ্গেই যে তাহার বিবাহ হইবে এ সম্বন্ধে কোনো পক্ষের মনে কোনো তর্ক বা সন্দেহ ছিল না । ধৰ্ম্মসামাজিক দোকানে যে ব্যক্তি নিজের উপরে খুব