পাতা:প্রবাসী (সপ্তম ভাগ, প্রথমাংশ).djvu/১৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

*२8 মাতার আর একটি অনুরোধ ছিল । তিনি বলিতেন,— তুই যে দিনরাত তোর ছাত্র বেণুগোপালের গল্প করিস তাহাকে একবার নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়া । তাহাকে আমার দেখিতে ইচ্ছা করে। হরলাল কহিল, “ম, এ বাসায় তাহাকে কোথায় বসাইব ? রোস, একটা বড় বাসা করি তাহার পরে তাছাকে নিমন্ত্রণ করিব।” হরলালের বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে ছোট গলি তইতে বড় গলি ও ছোট বাড়ি হইতে বড় বাড়িতে তাহার বাস পরিবর্তন হইল। তবু সে কি জানি কি মনে করিয়া, অধরলালের বাড়ি যাইতে বা বেণুকে নিজের বাসায় ডাকিয়া আনিতে কোনোমতেই মনস্তির করিতে পারিল না । হয় ত কোনো দিনই তাহর সঙ্কোচ ঘুচিত না। এমন সময়ে হঠাৎ খবর পাওয়া গেল বেণুর মা মারা গিয়াছেন । শুনিয়া মুহূৰ্ত্ত বিলম্ব না করিয়া সে অধরলালের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইল। এই দুই অসমবয়সী বন্ধুতে অনেক দিন পরে আবার একবার মিলন হইল । বেণুর অশোঁচের সময় পার ঠষ্টয়া গেল—তবু এ বাড়িতে হরলালের যাতায়াত চলিতে লাগিল । কিন্তু ঠিক তেমনটি আর কিছুই নাই। বেণু এখন বড় হইয়া উঠিয়া অঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনীযোগে তাঙ্গর নতন গোফের রেখার সাধ্যসাধনা করিতেছে । চালচলনে বাবুয়ান ফুটিয়া উঠিয়াছে। এখন তাহার উপযুক্ত বন্ধুবান্ধবের ও অভাব নাই। ফোনোগ্রাফে থিয়েটারের নটীদের ষ্টতর গান বাজাইয়া সে বন্ধুমহলকে আমোদে রাগে । পড়িবার ঘরে সেই সাবেক ভাঙা চৌকি ও দাগী টেবিল কোথায় গেল ! আয়নাতে, ছবিতে, আসবাবে ঘর যেন ছাতি ফুলাঃ য়া রহিয়াছে। বেণু এখন কলেজে যায় কিন্তু দ্বিতীয় বার্ষিকের সীমানা পার হইবার জন্ত তাহার কোন তাগিদ দেখা যায় না । বাপ স্থির করিয়া আছেন, দুষ্ট একটা পাস করাইয়া লষ্টয়া বিবাহের হাটে ছেলের বাজার দর বাড়াষ্টয়া তুলিবেন । কিন্তু ছেলের মা জানিতেন ও স্পষ্ট করিয়া বলিতেন, আমার বেণুকে সামান্ত লোকের ছেলের মত গৌরব প্রমাণ করিবার জন্ত পাসের হিসাব দিতে হইবে না-লোহার সিন্ধুকে কোম্পানির কাগজ অক্ষয় হইয়া থাক্‌! ছেলেও মাতার এ কথাটা বেশ করিয়া মনে মনে বুঝিয়া লইয়াছিল। যাহা হউক, বেণুর পক্ষে সে যে আজ নিতান্তই অনাবশ্বক তাহা হরলাল স্পষ্টই বুঝিতে পারিল এবং কেবলই থাকিয় থাকিয়া সেই দিনের কথা মনে পড়িল, যেদিন বেণু হঠাৎ প্রবাসী । [ १भ खांशं । । গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিল, মাষ্ট্রীর মশায়, আমাদের বাড়ি চল। সে বেণু নাই, সে বাড়ি নাই, এখন মাষ্টার মশায়কে কেই বা ডাকিবে । 3. হরলাল মনে করিয়াছিল এইবার বেণুকে তাহাদের বাসায় মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ করিলে । কিন্তু তfহাকে আহবান করিবার জোর পাইল না। একবার ভাবিল, উহাকে আসিতে বলিব, তাহার পরে ভাবিল বলিয়া লাভ কি-বেণু হয় ত নিমন্ত্রণ রক্ষা করিবে কিন্তু থাক্ । হরলালের মা ছাড়িলেন না । তিনি বার বার বলিতে লাগিলেন, তিনি নিজের হাতে রাধিয়া তাহাকে খাওয়াইবেন--"আহ! বাছার মা মারা গেছে ! অবশেষে হরলাল একদিন তাহাকে নিমন্ত্রণ করিতে গেল। কছিল অধর বাবুর কাছ তইতে অনুমতি লইয়া আসি । বেণু কঠিল, “অনুমতি লইতে হইবে না, আপনি কি মনে করেন আমি এখনও সেই থোকাবাবু আছি ?” হরলালের বাসায় বেণু থাইতে আসিল । মা এই কাৰ্ত্তিকের মত ছেলেটিকে তাঙ্গর দুষ্ট স্নিগ্ধচক্ষুর আশীৰ্ব্বাদে অভিষিক্ত করিয়া যত্ন করিয়া থা ওয়াইলেন। তাহার কেবলি মনে হইতে লাগিল অহা এই বয়সের এমন ছেলেকে ফেলিয়া ইহার মা যখন মরিল তখন তাহার প্রাণ না জানি কেমন করিতেছিল । আহার সারিয়াই বেণু কহিল---মাষ্ঠীর মশায়, আমাকে আজ একটু সকাল সকাল যাইতে হইবে। আমার দুই একজন বন্ধুর আসিবার কথা আছে। বলিয়া পকেট হইতে সোনার ঘড়ি খুলিয়া একবার সময় দেখিয়া লইল ; তাহার পরে সংক্ষেপে বিদায় লইয়া জুড়ি গাড়িতে চড়িয়া বসিল । হরলাল তাহার বাসার দরজার , কাছে দাড়াষ্টয়া রহিল। গাড়ি সমস্ত গলিকে কঁপাইয়৷ দিয়া মুহূৰ্ত্তের মধ্যেই চোখের বাহির হইয়া গেল । মা কহিলেন, হরলাল উহাকে মাঝে মাঝে ডাকিয়া আনিস্। এই বয়সে উহার মা মারা গেছে মনে করিলে আমার প্রাণটা কেমন করিয়া উঠে। *. হরলাল চুপ করিয়া রহিল। এই মাতৃহীন ছেলেটিকে সাস্বনা দিবার জন্ত সে কোনো প্রয়োজন বোধ করিল না । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কছিল- “রাস, এই পর্যন্ত ! আর কখনো ডাকিব না ! একদিন পাঁচ টাকা মাইনের মাষ্টারি করিয়াছিলাম বটে-কিন্তু আমি সামান্ত হরলাল মাত্র !” শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ( আগামী সংখ্যায় সমাপ্য ) ,