পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তৃতীচ্ছন্ন খণ্ড পুণ্যের স্পর্শ প্রথম পরিচ্ছেদ রমানন্দ স্বামী মুঙ্গেরের এক মঠে এক জন পরমহংস কিয়দিবস বসতি করিতেছিলেন । তাহার নাম রমানন্দ স্বামী । সেই ব্রহ্মচারী তাহার সঙ্গে বিনীতভাবে কথোপকথন করিতেছিলেন । অনেকে জানিতেন, রমানন্দ স্বামী সিদ্ধপুরুষ । তিনি অদ্বিতীয় জ্ঞানী বটে। প্রবাদ ছিল যে, ভারতবর্ষের লুপ্ত দর্শনবিজ্ঞান সকল তিনিই জানিতেন । তিনি বলিতেছিলেন, “শুন বৎস চন্দ্রশেখর ! যে সকল বিদ্য। উপার্জন করিলে, সাবধানে প্রয়োগ করিও । আর কদাপি সন্তাপকে হৃদয়ে স্থান দিও না । কেন না, দুঃখ বলিয়। একটা স্বতন্ত্র পদার্থ নাই। সুখ দুঃখ তুল্য বা বিজ্ঞের কাছে একই । যদি প্রভেদ কর, তবে যাহারা পুণ্যাত্মা বা সুখী বলিয়া খ্যাত, তাহাদের চির-দুঃখী বলিতে হয় ।” এই বলিয়া রমানন্দ স্বামী প্রথমে যযাতি, হরিশ্চন্দ্র, দশরথ প্রভৃতি প্রাচীন রাজগণের কিঞ্চিৎ প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন । ত্রীরামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির, নল রাজা প্রভৃতির কিঞ্চিৎ উল্লেখ করিলেন । দেখাইলেন, সাৰ্ব্বভৌম মহাপুণ্যাত্মা রাজগণ চির দুঃখী—কদাচিৎ সুখী। পরে বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র প্রভৃতির কিঞ্চিৎ উল্লেখ করিলেন—দেখাইলেন, তাহারাও দুঃখী । দানবপীড়িত, অভিশপ্ত ইন্দ্রাদি দেবতার উল্লেখ করিলেন-দেখাইলেন, সুরলোকও দুঃখপূর্ণ। শেষে মনোমোহিনী বাকশক্তির দৈবাবতারণা করিয়া অনন্ত অপরিজ্ঞেয় বিধাতৃ হৃদয়মধ্যে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন । দেখাইলেন যে, যিনি সৰ্ব্বজ্ঞ, তিনি এই জুঃখময় অনস্ত সংসারে অনন্ত দুঃখরাশি অনাদি অনস্তকালাবধি হৃদয়মধ্যে অবশ্ব অনুভূত করেন । যিনি দয়াময়, তিনি কি সেই দুঃখরাশি অনুভূত করিয়৷ দুঃখিত হন না ? তবে দয়াময় কিসে? দুঃখের সঙ্গে দয়ার নিত্য সম্বন্ধ—দুঃখ না হইলে দয়ার সঞ্চার কোথায় ? যিনি দয়াময়, তিনি অনন্ত সংসারের অনন্ত দুঃখে অনন্তকাল দুঃখী-নচেৎ তিনি দয়াময় নছেন । যদি বল, তিনি নিৰ্ব্বিকার, তাহার দুঃখ কি ? উত্তর এই যে, ষিনি নিৰ্ব্বিকার, তিনি সৃষ্টিস্থিতি সংহারে স্পৃহাশূন্ত—তাহাকে স্রষ্ট বিধাতা বলিয়া মানি না । যদি কেহ স্রষ্টা বিধাতা থাকেন, তবে র্তাহাকে নির্কিকার বলিতে পারি না । তিনি তুঃখময় । কিন্তু তাহাও হইতে পারে না, কেন না, তিনি নিত্যনন্দ । অতএব দুঃখ বলিয়া কিছু নাই, ইহাই সিদ্ধ । রমানন্দ স্বামী বলিতে লাগিলেন, “আর যদি দুঃখের অস্তিত্বই স্বীকার কর, তবে এই সৰ্ব্বব্যাপী দুঃখ-নিবারণের উপায় কি নাই ? উপায় নাই ; তবে যদি সকলে সকলের দুঃখনিবারণের জন্য নিযুক্ত থাকে, তবে অবশ্য নিবারণ হইতে পারে। দেখ, বিধাতা স্বয়ং অহরহ সৃষ্টির দুঃখনিবারণে নিযুক্ত। সংসারের সেই দুঃখনিবৃত্তিতে ঐশিক দুঃখেরও নিবারণ হয় । দেবগণ জীবদ্যুঃখ-নিবারণে নিযুক্ত –তাহাতেই দৈব সুখ । নচেৎ ইন্দ্রিয়াদিবিকারশূন্ত দেবতার অন্য সুখ নাই। পরে ঋষিগণের লোকহিতৈষিত কীৰ্ত্তন করিয়া ভীষ্মাদি দেবগণের পরোপকারিতার বর্ণন করিলেন । দেখাইলেন, যেই পরোপকারী, সেই সুখী, অন্য কেহ সুখী নহে। তখন রমানন্দ স্বামী শতমুখে পরোপকার-ধৰ্ম্মের গুণকীৰ্ত্তন আরম্ভ করিলেন । ধৰ্ম্মশাস্ত্র বেদ, পুরাণেতিহাস প্রভৃতি মন্থন করিয়া অনর্গল ভূরি ভূরি প্রমাণ প্রযুক্ত করিতে লাগিলেন । শব্দসাগর মন্থন করিয়া শত শত মহাৰ্থ, শ্রবণ-মনোহর বাক্যপরম্পরা কুসুমমালাবৎ গ্রন্থন করিতে লাগিলেন--সাহিত্য-ভাণ্ডার লুণ্ঠন করিয়া সারবতী, রসপূর্ণ সদলঙ্কারবিশিষ্ট কবিতানিচয় বিকীর্ণ করিতে লাগিলেন । সৰ্ব্বোপরি আপনার অকৃত্রিম ধৰ্ম্মানুরাগের মোহময়ী প্রতিভান্বিত ছায়া বিস্তারিত করিলেন । র্তাহার সুকণ্ঠ-নির্গত উচ্চারণকৌশলযুক্ত সেই অপূৰ্ব্ব বাক্যসকল চন্দ্রশেখরের কণ্ঠে তুর্য্যনাদবৎ ধ্বনিত হইতে লাগিল । সে বাক্যসকল কখনও মেঘগর্জনবৎ গম্ভীর শব্দে শদিত হইতে লাগিল—কখন বীণানিক্কণবৎ মধুর বোধ হইতে লাগিল । ব্রহ্মচারী বিস্মিত, মোহিত হইয়া উঠিলেন । র্তাহার শরীর কণ্টকিত হইয়। উঠিল । তিনি গাত্ৰোখান করিয়া রমানন্দ স্বামীর পদ রেণু গ্রহণ