পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

“ চন্দ্রশেখর ...প্রতাপের আহ্লাদ হইল। মনে ভাবিলেন, নবাৰ কি? এই অস্বরদিগকে বাঙ্গাল হইতে তাড়াইতে *পরিবেন না ? ফষ্টর কি ধৃত হইবে না ?

তার পর মনে ভাবিলেন, যাহার যেমন শক্তি, তাছার, কর্তব্য, এই কার্য্যে নবাবের সাহায্য করে। কাষ্ঠবিড়ালেও সমুদ্র বাধিতে পারে।

তার পুর মনে ভাবিলেন, আম হইতে কি কোন সাহায্য হইতে পারে না ? আমি কি করিতে পারি ? তার পর মনে ভাবিলেন , আমার সৈন্য নাই, কেবল লাঠিয়াল আছে—দস্থ্য আছে । তাহাদিগের দ্বার কোন কাৰ্য্য হইতে পারে ? ভাবিলেন, আর কোন কাৰ্য্য না হউক, লুঠপাঠ হইতে পারে। যে গ্রাম ইংরেজের সাহায্য করিবে, সে গ্রাম লুঠ করিতে পারিব । যেখানে দেখিব, ইংরেজের রসদ লষ্টয় ষাইতেছে, সেইখানেই রসদ লুঠ করিব । যেখানে দেখিব, ইংরেজের দ্রব্যসামগ্ৰী যাইতেছে, সেইখানেই দক্ষ বৃত্তি অবলম্বন করিব । ইহা করিলেও নবাবের অনেক উপকার করিতে পারিব ! সম্মুখ সংগ্রামে যে জয়, তাই বিপক্ষবিপাশের সামাষ্ঠ উপায়মাত্র । সৈঙ্গের পৃষ্ঠরোপ এবং খাদ্য হরণের ব্যাঘাত, প্রদান উপায় । যত দূর পারি, তত দূর তাহ করিব : তার পর ভাবিলেন. আমি কেন এত করিব ? করিব, তাহার অনেক কারণ তা;ছে । প্রথম, ইংরেজ চন্দ্রশেখরের সর্বনাশ করিপ্লাছে ; দ্বিতীয়, শৈবলিনী মরিয়াছে ; তৃ হয়, আমাকে কয়েদ করিয়াছিল ; চতুর্থ, এইরূপ অনিষ্ট তার আর লোকেরও করিয়াছে ও করিতে পারে ; পঞ্চম, নবাবের এ উপকার করিতে পারিলে, ই একখান। বড় বড় পরগণ। পাইতে পরিব । অতএব আমি ইহা করিব । প্রতাপ তখন অমা ভাবগের খোসামোদ করিয়া নবাবের সঙ্গে সাক্ষাং করিলেন । নবাবের সঙ্গে তাহার কি কি কথ। হুইল, তাহ অপ্রকাশ রহিল ! নবাবের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করিলেন । .অনেক দিনের পর, তাহার স্বদেশে আগমনে রূপসীর গুরুতর চিন্ত দূর হইল। কিন্তু রূপসী শৈবলিনীর মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া দুঃখিত হইল। প্রতাপ আসিয়াছেন শুনিয়া সুন্দরী তাহীকে দেখিতে আসিল । সুন্দরী শৈবলিনীর মৃত্যুসংবাদ শুনিয়। নিতান্ত দুঃখিত হইল । কিন্তু বলিল, “ষাহা হইবার, তাহ হইয়াছে। কিন্তু শৈবলিনী এখন সুখী হইল ; তাহার বাচ। 8S) অপেক্ষ মরাই যে মুখের, তা আর কোন মুখে না বলিব ?” প্রতাপ রূপসী ও সুন্দরীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর পুনৰ্ব্বার গৃহত্যাগ করিয়া গেলেন । অচিরাৎ দেশে দেশে রাষ্ট হইল যে, মুঙ্গের হইতে কাটোয় পৰ্য্যন্ত যাবতীয় দস্থ্য ও লাঠিয়াল দলবদ্ধ হইতেছে, প্রতাপ রায় তাহাদিগকে দলবদ্ধ করিতেছে । শুনিয়। গুরুগন খ চিন্তাযুক্ত হইলেন ! দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শৈবলিনী কি করিল ? মহন্ধকারময় পৰ্ব্বতগুহ!—পৃষ্ঠচ্ছেদা উপল-শয্যায় শুইয়। শৈবলিনী । মহাকায় পুরুষ শৈবলিনীকে তথ{য় ফেলিয়| দিয়। গিয়াছেন । ঝড়বৃষ্টি আসিয়া গিয়াছে—কিন্তু গুহ্যমধ্যে অন্ধকার—কেবল অন্ধকার—কেবল অন্ধকার—অন্ধকারে ঘোরতর নিঃশব্দ । নয়ন মুদিলে অন্ধকার—চক্ষু চাহিলে তেমনই অন্ধকার । নিঃশব্দ–কেবল কোথাও পৰ্ব্বতস্থ রন্ধ্রপথে বিন্দু বিন্দু বারি গুহাতলস্থ শিলার উপরে পড়িয়া ক্ষণে ক্ষণে টিপ টপ শব্দ করিতেছে । অ৷র যেন কোন জীব, মনুষ্য কি পশু-কে জানে ?— সেই গুহামধ্যে নিশ্বাস ত্যাগ করিতেছে । এতক্ষণে শৈবলিনী ভয়ের বশীভূত হইল। ভয় ? তাহাও নহে । মনুষ্যের স্থিরবুদ্ধিতার সীমা আছে— শৈবলিণী সেই সীমা অতিক্রম করিয়াছিল । শৈবলিনীর ভয় নাই—কেন না, জীবন তাহার পক্ষে অবহনীয়, অসহনীয় ভার হইয়া উঠিয়াছিল—ফেলিতে পারিলেই ভাল । বাকী যাহ। —মুখ, ধৰ্ম্ম, জাতি, কুল, মান সকলই গিয়াছে—আর যাইবে কি ? কিসের उछनू ? কিন্তু শৈবলিনী আশৈশব, চিরকাল যে আশা হৃদয়মপে সযত্নে, সঙ্গোপনে পালিত করিয়াছিল, সেই দিন বা তাহার পূৰ্ব্বেই তাহার উচ্ছেদ করিয়াছিল ; যাহার জষ্ঠ সৰ্ব্বত্যাগিনী হইয়াছিল, এক্ষণে তাহাও ত্যাগ ক রয়াছে : চিত্ত নিতান্ত বিকল—নিতান্তু বলশূন্য । আবার প্রায় জুই দিন অনশন, তাহাতে পথ শ্রান্তি, পৰ্ব্বতারোহণশ্রান্তি; বাত্যাবৃষ্টিজনিত পীড়াভোগ, শরীরও নিতান্ত বিকল--নিতাস্ত বলশূন্ত । তাহার পর এই ভীষণ দৈব ব্যাপার—দৈব বলিয়াই শৈবলিনীর বোধ হইল-মানবচিত্ত আর কতক্ষণ প্রকৃতিস্থ থাকে ? দেহ ভাঙ্গিয়া পড়িল, মন ভাঙ্গিয় পড়িল—শৈবলিনী অপহৃতচেতনা হইয়।