পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

করিয়া জীবিকাম্বেষণে বাঙ্গালায় আসে । দলনী যখন মীর কাসেমের গৃহে বাদীস্বরূপ প্রবেশ করে, তখন উভয়ে উভয়ের উপকারার্থ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় ।” কুলুসম তাহার পরে, যে রাত্রে তাহারা দুই জনে গুরুগম্‌ ৰ্থার ভবনে গমন করে, তদব্ৰত্তাস্ত সবিস্তারে বলিল । গুবৃগন্‌ খাঁর সঙ্গে যে সকল কথাবাৰ্ত্ত হয়। তাহা দলনীর মুখে শুনিয়াছিল, তাহাও বলিল । তৎপরে প্রত্যাবৰ্ত্তন আর নিষেধ, ব্রহ্মচারীর সাহাষ্য, প্রতাপের গৃহে অবস্থিতি, ইংরেজগণকৃত আক্রমণ এবং শৈবলিনীভ্রমে দলনীকে হরণ, নৌকায় কারাবাস, আমিয়ট প্রভৃতির মৃত্যু, ফষ্টরের সহিত র্তাহাদিগের পলায়ন, শেষে দলনীকে গঙ্গাতীরে ফষ্টরকৃত পরিত্যাগ, এ সকল বলিয়৷ শেষে বলিতে লাগিল, “আমার স্কন্ধে সেই সময় সয়তান চাপিয়াছিল সন্দেহ নাই, নহিলে আমি সে সময়ে বেগমকে কেন পরিত্যাগ করিব ? আমি সেই পাপিষ্ঠ ফিরিঙ্গীর দুঃখ দেখিয়া তাহার প্রতি—মনে করিয়াছিলাম—সে কথ। যাউক । মনে করিয়াছিলাম, নিজামতের নৌকা পশ্চাৎ আসিতেছে—বেগমকে তুলিয়া লইবে—নহিলে আমি তাহাকে ছাড়িব কেন ? কিন্তু তাহার যোগ্য শাস্তি আমি পাইয়াছি—বেগমকে পশ্চাৎ করিয়াই অামি কাতর হষ্টয় ফষ্টরকে সাধিয়াছি যে, আমাকেও নামাইয়া দাও—সে নামাইয় দেয় নাই । কলিকাতায় গিয়৷ সাহাকে দেখিয়াছি—তাহাকেই সাধিয়াছি যে, আমাকে পাঠাষ্টয় দাও—কেহ কিছু বলে নাই । শুনিলাম, হেষ্টিংস সাহেব বড় দয়ালু —তাহার কাছে কঁাদিয়া গিয়া তাহার পয়ে ধরিলাম—তাহারই কপায় আসিয়াছি । এখন তোমর! আমার বধের উদ্যোগ কর—আমার আর বঁাচিতে ইচ্ছা নাই ।” এই বলিয়া কুলসমৃ কাদিতে লাগিল । বহুমূল্য সিংহাসনের শত শত রশ্মি প্রতিঘাতী রত্নরাজির উপরে বসিয়া, বাঙ্গালার নবাব,—অধোবদন । এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের রাজদণ্ড তাহার হস্ত হইতে ত স্বলিত হইয়া পড়িতেছে—বহু যত্নেও ত রহিল না । কিন্তু যে অজেয় রাজ্য বিন যত্নে থাকিত—সে কোথায় গেল ! তিনি কুসুম ত্যাগ করিয়া কণ্টকে যত্ন করিয়াছেন—কুলসমৃ সত্যই বলিয়াছে—বাঙ্গালার নবাব মুর্থ ! নবাব ওমরাহদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “তোমরা শুন, এ রাজ্য আমার রক্ষণীয় নহে। এই বাদী যাহা বলিল, তাহা সত্য—বাঙ্গালার নবাব মুর্থ। তোমরা পার, সুবা রক্ষা কর, আমি চলিলাম । আমি রুহিদাসের গড়ে স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে লুকাইয়। ৬১ থাকিৰ, অথবা ফকিরি গ্রহণ করিব।”—বলিতে বলিতে নবাবের বলিষ্ঠ শরীর,—প্রবাহমধ্যে রোপিত ংশখণ্ডের দ্যায় কঁাপিতেছিল—চক্ষের জল সংবরণ করিয়া মীর কাসেম বলিতে লাগিলেন, “শুন, বন্ধুবৰ্গ ! যদি আমাকে সেরাজ-উদ্দৌলার ন্যায় ইংরেজ বা তাহাদের অনুচর মারিয়া ফেলে, তবে তোমাদের কাছে আমার এই ভিক্ষা, সেই দলনীর কবরের কাছে আমার কবর দিও। আর আমি কথা কহিতে পারি না-- এখন যাও । কিন্তু তোমরা আমার এক আজ্ঞা পালন কর – আমি সেই তকি খাকে একবার দেখিব —আলি ইব্রাহিম খাঁ৷ ” ইব্রাহিম খা উত্তর দিলেন । নবাব বলিলেন, “তোমার ন্যায় আমার বন্ধু জগতে নাই—তোমার কাছে আমার এই ভিক্ষা তকি খাকে আমার কাছে লইয়া আইস ।” ইব্রাহিম খ! অভিবাদন করিয়া তাঙ্গুর বাহিরে গিয়া অশ্বারোহণ করিলেন । নবাব তখন বলিলেন “আর কেহ আমার উপকার করিবে ?” সকলেই যোড়হাত করিয়া হুকুম চাহিল। নবাব বলিলেন, “কেহ সেই কষ্টরকে আনিতে পার ?” আমীর হোসেন বলিলেন, “সে কোথায় আছে, আমি তাহার সন্ধান করিতে কলিকাতায় চলিলাম।” নবাব ভাবিয়া বলিলেন, “আর সেই শৈবলিনীকে ? তাহাকে কেহ আনিতে পারিবে ? মহম্মদ ইবৃফান যুক্তকরে নিবেদন করিল, “অবশু এত দিন সে দেশে আসিয়া থাকিবে, আমি তাহাকে লষ্টয়া আসিতেছি ।” এই বলিয়া মহম্মদ ইরফান বিদায় হইল । তাহার পর নবাব বলিলেন, “যে ব্রহ্মচারী বেগমকে মুঙ্গেরে আশ্রয় দান করিয়াছিলেন, তাহার কেহ সন্ধান করিতে পার ?” মহম্মদ ইবৃক্ষণম্ বলিল, “হুকুম হইলে শৈবলিনীর সন্ধানের পর ব্রহ্মচারীর উদ্দেশে মুঙ্গের যাইতে পারি ” শেষ কাসেম আলি বলিলেন, “গুরুগন খাঁ কত দুর ?" অমাত্যবর্গ বলিলেন, “তিনি ফৌজ লইয়া উদয়নালায় আসিতেছেন শুনিয়াছি—কিন্তু এখনও পৌছেন নাই ।” নবাব মৃদু মৃদু বলিতে লাগিলেন, “ফৌজ ! ফোঁজ । কাহার ফৌজ ?” - এক জন কে চুপি চুপি বললেন, “তারি।”