পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কঁপালকুণ্ডল ఏ করিয়া দেখিলেন যে, এক বৃক্ষের সােল বাদামের গ্যায় অতি স্বস্বাদু ; তস্থার ক্ষুধানিরক্তি করিলেন । কথিত বালুকাস্তুপশ্রেণী প্রস্থে অতি অল্প, অতএব নবকুমার অল্পকাল ভ্রমণ করিয় তাহা পার হইলেন। তৎপরে বালুকাবিহীন নিবিড় বনমধ্যে পড়িলেন । যাহার ক্ষণকালজন্য অপূৰ্ব্বপরিচিত বনমধ্যে ভ্রমণ করিয়াছেন, তাহারা জানেন যে, পথহীন বনমধ্যে ক্ষণমধ্যেই পথভ্রাপ্তি জন্মে । নবকুমারের তাহাই ঘটিল। কিছু দৃদ্ধ আসিয়া আশ্রম কোন পথে রাখিয়া আসিয়াছেন, তাহা স্থির করিতে পারিলেন না । গম্ভীর জলকল্লেল তাহার কর্ণপথে প্রবেশ করিল। তিনি বুঝিলেন যে, এ সাগরগর্জন ! ক্ষণকাল পরে অকস্মাৎ বনমধ্য হইতে বহির্গত হইয়৷ দেখিলেন যে, সম্মুখেই সমুদ্র । অনস্তবিস্তার নীলাম্বু মণ্ডল সম্মুখে দেখিয়৷ উৎকটানন্দে হৃদয় পরিপ্লুত হইল । সিকতাময় তটে গিয়া উপবেশন করিলেন । ফেনিল, নীল, অনন্ত সমুদ্র । উভয়পাশ্বে যতদূর চক্ষুঃ যায়, ততদূর পর্য্যন্ত তরঙ্গভঙ্গপ্রক্ষিপ্ত ফেনার রেখা, স্তুপীকৃত বিমল কুসুমদামগ্রথিত মালার ন্যায় সে ধবল ফেনরেখা হেমকান্ত সৈকতে ন্যস্ত হইয়াছে ; কাননকুন্তল ধরণীর উপযুক্ত অলকাভরণ নীলজলমণ্ডলমধ্যে সহস্ৰ স্থানেও সফেন তরঙ্গভঙ্গ ইষ্টতেছিল । যদি কখনও এমন প্রচণ্ড বায়ুবহন সম্ভব হধ যে, তাহার বেগে নক্ষত্রমালা সহস্ত্ৰে সহস্ৰে স্থানচ্যুত হইয়। নীলাম্বরে আন্দোলিভ হইতে থাকে, তবেই সে সাগরতরঙ্গক্ষেপের স্বরূপ দৃষ্ট হইতে পারে । এ সময়ে অস্তগামী দিনমণির মৃদুল কিরণে নীল জলের একাংশ দ্রবীভূত সুবর্ণের ন্যায় জ্বলিতেছিল । অতিদূরে কোন ইউ রোপীয় বণিকজাতিৰ সমুদ্রপে। ত শ্বেতপক্ষ বিস্তাব করিয়া বৃহৎ পক্ষীর ন্যায় জলপিঙ্গদযে উড়িতেছিল । কতক্ষণ যে নবকুমার তারে বসিয়া অন্যমনে জলধিশোভা দৃষ্টি করিতে লাগিলেন, তদ্বিষয়ে তৎকালে তিনি পরিমাণ বোধ রহিত । পরে একেবারে প্রদোষ তিমির আসিয়া কাল জলের উপর বসিল । তখন নবকুমারের চেতন হইল ষে, আশ্রম সন্ধান করিয়৷ লইতে হইবে । দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া গাত্রোগান করিলেন । দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন কেন, তাহা বলিতে পারি না—তখন তাহার মনে কোন ভূতপূৰ্ব্ব সুখের উদয় হইতেছিল, তাই কে বলিবে ? গালে৷ থান করিয়া সমুদ্রের দিকে পশ্চাৎ ফিরিলেন । ফিরিবামাত্র দেখিলেন, অপুৰ্ব্ব মূৰ্ত্তি ! সেই গম্ভীর নাদিবারিধিতীরে, সৈকতভূমে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে দাড়াইয়া অপূৰ্ব্ব রমণী মূৰ্ত্তি ! কেশভার-অবেণীসংবদ্ধ, ৩য়—২০ সংসপিণ্ড, পাশঞ্চত, আ গুল্ফ লম্বিত কেশভার ; তদগ্রে দেহর: ; যেন চি.পেটের উপর চির দখ| সাইতেছে । অলকাবলীর প্রাচুর্যে মুখমণ্ডল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ হইতেছিল না-তথাপি মেঘবিচ্ছেদনিঃস্তত চন্দ্ররশ্মির দ্যায় প্রভাত শুইতেছিল। বিশাল লোচনে কটাক্ষ, অতি স্থির, অতি স্নিগ্ধ, অতি গম্ভীর অথচ জ্যোতিৰ্ম্ময় ; সে কটাক্ষ, এই সাগরহাদয়ে ক্রীড়াশীল চন্দ্রকিরণলেখার দ্যায় মিগ্ধোজ্জল দীপ্তি পাইতেছিল । কেশরাশিতে স্কন্ধদেশ ও বাহুমূগল আচ্ছন্ন করিয়াছিল । স্কন্ধদেশ একেবারে অদৃশু বাহুযুগলের বিমল শ্ৰী কিছু কিছু দেখা যাইতেছিল । রমণীদেহ একেবারে নিরাভরণ । মূৰ্ত্তিমধ্যে সে একটি মোহিনী শক্তি ছিল, তাহ বণিতে পারা যায় না । অৰ্দ্ধচন্দ্রনিঃস্তত কৌমুদীবৰ্ণ ; ঘনকৃষ্ণ চিকুরজাল ; পরস্পরের সান্নিধ্যে কি বর্ণ, কি চিকুর, উভয়েরই সে শ্ৰী বিকশিত হইতেছিল, তাহা সেই গম্ভীরনাদা সাগরকুলে সন্ধ্যালোকে না দেখিলে, তাহার মোহিনী শক্তি অনুভূত হয় না । নবকুমার অকস্মাৎ এইরূপ দুৰ্গমমধ্যে দৈবী মূৰ্ত্তি দেখিয় নিম্পন্দশরীর হইয়া দাড়াইলেন । র্তাহার বাকৃশক্তি রহিত হইল,—স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিলেন J", রমণীও স্পন্দীন, অনিমেষলোচনে বিশাল চক্ষুর স্থিরr: দৃষ্টি নবকুমারের মুখে ন্যস্ত করিয়া রাখিলেন। উভয়-- মধ্যে প্রভেদ এই যে, নবকুমারের দৃষ্টি চমকিত । লোকের দৃষ্টির ত্যায়, রমণীর দৃষ্টিতে সে লক্ষণ কিছুমাত্র নাই, কিন্তু তাঁহাতে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ হইতেছিল। অনন্তর সমুদ্রের জনহীন ভীরে, এইরূপে বহুক্ষণ দুই জনে চাহির রহিলেন । অনেকক্ষণ পরে তরুণীর কণ্ঠস্বর শুল। গেল । তিনি অতি মুঢ়স্বরে কহিলেন, “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ ?” এষ্ট কণ্ঠস্বরের সঙ্গে নবকুমারের হৃদয়বীণা বাজিয়া উঠিল । বিচিত্র সৃদয়মন্থের তন্ত্রীচয় সময়ে সময়ে এরূপ লয়ঙ্গীন হইরা থাকে যে, যত ধত্ব করা যায়, কিছুতেই পরস্পর মিলিত হয় না, কিন্তু একটি শব্দে, একটি রমণীকণ্ঠসস্থতস্বর সংশোধিত হইয়া যায় ; সকলই লয়বিশিষ্ট হয়, সংসারযান সেই অবধি সুখময় সঙ্গীত প্রবাহ বলিয়। বোধ হয় । নবকুমারের কর্ণে সেইরূপ এ ধ্বনি বাজিল । “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ ?" এ ধ্বনি নবকুমারের কণে প্রবেশ করিল। কি অর্থ, কি উত্তর করিতে হইবে, কিছুই মনে হইল না । ধ্বনি যেন ইর্যবিকম্পিত হইয় বেড়াইতে লাগিল ; যেন পবনে সেই ধ্বনি বহিল ; বৃক্ষপত্রে মৰ্ম্মরিত হইতে লাগিল ; সাগরনাদে যেন মনীভূত হইতে লাগিল । সাগরধসন।