পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কপালকুণ্ডল৷ প্রাচীরবেষ্টিত একটি গৃহও দেখা গেল। কপালকুণ্ডল৷ প্রাচীরদ্বারের নিকটস্থ হইয় তাহাতে করাঘাত করিতে লাগিলেন ; পুনঃ পুনঃ করাঘাত করাতে ভিতর হইতে এক ব্যক্তি কহিল, “কে ও, কপালকুণ্ডলা বুঝি ?” কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “দ্বার খোল ।” উত্তরকারী আসিয়া দ্বার খুলিয়। দিল । ষে ব্যক্তি দ্বার খুলিয়া দিল, সে ঐ দেবালয়াধিষ্ঠাত্রী দেবতার সেবক বা অধিকারী ; বয়সে পঞ্চাশত বৎসর অতিক্রম করিয়াছিল। কপালকুণ্ডল। তাহার বিরলকেশ মস্তক কর দ্বারা আকৰ্ষিত করিয়া আপন অধরের নিকট তাহার শ্রবণেন্দির আনিলেন এবং তই চারি কথায় নিজ সঙ্গীর অবস্থা বুঝাইয়া দিলেন । অধিকারী বহুক্ষণ পর্য্যন্ত করতললগ্নশীর্ষ হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন । পরিশেষে কহিলেন, “এ বড় বিষম ব্যাপার । মহাপুরুষ মনে করিলে সকল করিতে পারেন । যাহা হউক, মায়ের প্রসাদে তোমার অমঙ্গল ঘটিবে না । সে ব্যক্তি কোথায় ?” কপালকুণ্ডলা, “আইস" বলিয়া নবকুমারকে আহবান করিলেন । নবকুমার আস্তরালে দাড়াইয়।ছিলেন, আহত হইয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন । অধিকারী তাতাকে কহিলেন, “আজি এইখানে লুকাইয়া থাক, কালি প্রতুৰে তোমাকে মেদিনীপুরের পথে রাখিয়া আসিব ।” ক্রমে কথায় কথায় অধিকারী জানিতে পারিলেন যে, এ পর্যস্ত নবকুমারের আহারাদি হয় নাই । ইহাতে অধিকারী তাহার অtহারের আয়োজন করিতে প্রবৃত্ত হইলে, নবকুমার আহারে নিতান্ত অস্বীকত হইয়৷ কেবলমাত্র বিশ্রাম-স্থানের প্রার্থন জানাইলেন । অধিকারী নিজ রন্ধনশালায় নবকুমারের শয্যা প্রস্তুত করিয়া দিলেন। নবকুমার শয়ন করিলে, কপাল কুণ্ডলা সমুদ্রতীরে প্রত্যাগমন করিবার উদ্যোগ করিলেন । অধিকারী তাহার প্রতি সস্নেহনয়নে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “যাক্টও না । ক্ষণেক দাড়াও, এক ভিক্ষা আছে।” কপালকুণ্ডলা । কি ? অধিকারী । তোমাকে দেখিয়া পৰ্য্যস্ত ম৷ বলিয়া থাকি, দেবীর পাদস্পর্শ করিয়। শপথ করিতে পারি যে, মাতার অধিক তোমাকে স্নেহ করি । আমার ভিক্ষ অবহেলা করিবে না ? কপা । করিব না । অধি। আমার এই ভিক্ষ, তুমি আর সেখানে ফিরিয়া যাইও না । কপা । কেন ? ్సరి অধি ! গেলে তোমার রক্ষা নাই । কপা । তাহ ত জল । আধি । তবে অর জিজ্ঞাস কর কেন ? কপ। । ল| গিয়া কোথায় সাইব ? অপি । এই পথিকের সঙ্গে দেশাস্তরে যাও । কপালকুণ্ডলা নীরব হুইয়া রহিলেন । অধিকারী কহিলেন, “মা, কি ভাবিতেছ ?” কপ। যখন তোমার শিষ্ঠ আসিয়াছিল, তখন তুমি কহিয়াছিলে যে যুবৃত্বীপ এরূপ সুবাপুরুষের সস্থিত যাওয়া অনুচিত ; এখন যাইতে বল কেন ? আধি । তখন তোমার জীবনের আশঙ্কা করি নাই, বিশেষ যে সদ্যপায়ের সম্ভাবনা ছিল না, এখন সে সদ্যপায় হইতে পারিবে । তাইস, মায়ের অনুমতি লইয়৷ আসি । এই বলিয়া অধিকারী দীপহস্তে দেবালয়ের দ্বারে গিয়া দ্বারোদঘাটন করিলেন । কপালকুণ্ডলাও তাহার সঙ্গে সঙ্গে গেলেন । মন্দিরমধ্যে মানবাকার পরিমিত করালকলীমূৰ্ত্তি সংস্থাপিত ছিল। উভয়ে ভক্তিভাবে প্রণাম করিলেন । অধিকারী আচমন করিয়া পুষ্পপাত্র হইতে একটি অচ্ছিন্ন বিল্বপত্র লইয়া মন্ত্ৰপূত করিলেন এবং তাহ প্রতিমার পদোপরি সংস্থাপিত করিয়া তৎপ্রতি চাহিয়া রহিলেন । ক্ষণেক পরে অধিকারী কপালকুণ্ডলাকে কহিলেন, “ম, দেখ, দেবী অৰ্ঘ্য গ্রহণ করিয়ছেন, বিল্বপত্র পড়ে নষ্ট, যে মানস করিয়৷ অৰ্ঘ্য দিয়াছিলাম, তাহাতে অবখ্য মঙ্গল । তুমি এই পথিকের সঙ্গে সচ্ছন্দে গমন কর । কিন্তু আমি বিধর্মী লোকের রীতি চরিত্র জানি। তুমি যদি গলগ্ৰহ হইয়৷ ইহার সঙ্গে যাও, তবে এ ব্যক্তি অপরিচিত যুবর্তী সঙ্গে লইয়। লোকালয়ে লজ্জ পাইবে : তোমাকেও লোকে রণা করিপে । তুমি বলিতেছ, এ ব্যক্তি ব্ৰাহ্মণসস্তান : গলাতেও যজ্ঞোপবীত দেখি তেছি । এ সদি তোমাকে বিবাহ করিয়া লইয়। মায়, তবে সকল মঙ্গল । নচেৎ আমিও তোমাকে ইহার সঠিত যাইতে বলিতে পারি ন৷ ” “বি—দ। —ছ ” এই কথাটি কপালকগুলা অতি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করিলেন । বলিতে লাগিলেন, “বিবাহের নাম ত তোমাদিগের মুখে শুনিয়! থাকি, কিন্তু কাহাকে বলে, সবিশেস জানি না ! কি করিতে হইবে ?" অধিকারী ঈষন্মাত্র হাস্ত করিয়। কহিলেন, “বিবাহ স্ত্রীলোকের একমাত্র ধৰ্ম্মের সোপান : এই জন্য স্ত্রীকে সহধৰ্ম্মিণী বলে ; জগন্মাতাও শিবের বিবাহিত ।"