পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২২ কপালকুণ্ডলার সহিত প্রণয়সম্ভাষণ করেন নাই ; পরিপ্লবোম্মুখ অনুরাগসিন্ধুতে বাচিমাত্র বিক্ষিপ্ত হইতে দেন নাই। কিন্তু সে আশঙ্কা দুর হইল। জলরাশির গতিমুখ হইতে বেগনিরোধকারী উপলমোচনে যেরূপ দুৰ্দ্দম স্রোতোবেগ জন্মে, সেইরূপ বেগে নবকুমারের প্রণয়সিন্ধু উছলিয়া উঠিল। এই প্রেমাবির্ভাব সৰ্ব্বদা কথায় ব্যক্ত হইত না, কিন্তু নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে দেখিলেই যেরূপ সজললোচনে তাহার প্রতি আনিমিখ চাহিয়। থাকিতেন, তাহাতেই প্রকাশ পাইত ; যেরূপ নিম্প্রয়োজনে, প্রয়োজন কল্পনা করিয়া কপালকুণ্ডলার কাছে আসিতেন, তাহাতে প্রকাশ পাইত ; যেরূপ বিনাপ্রসঙ্গে কপালকুণ্ডলার কাছে আসিতেন, তাহাতে প্রকাশ পাইত ; যেরূপ বিনাপ্রসঙ্গে কপালকুণ্ডলার ‘প্রসঙ্গ উত্থাপনের চেষ্টা পাইতেন, তাহাতে প্রকাশ পাইত ; যেরূপ দিবানিশি কপালকুণ্ডলার মুখস্বচ্ছন্দ তার অন্বেষণ করিতেন, তাহাতে প্রকাশ পাইত ; সৰ্ব্বদা অষ্টমনস্কত{সূচক পদবিক্ষেপও প্রকাশ পাইত । তাহার প্রকৃতি পর্যান্ত পরিবৰ্ত্তিত হইতে লাগিল । যেখানে চাপল্য ছিল, সেখানে গাম্ভীৰ্য্য জন্মিল ; যেখানে অপ্রসাদ ছিল, সেখানে প্রসন্নত জন্মিল ; নবকুমারের মুখ সৰ্ব্বদাই প্রফুল্ল । হৃদয় মেহের আধার হওয়াতে অপর সকলের প্রতি স্নেহের আধিক্য জন্মিল ; বিরক্তিজনকের প্রতি বিরাগের লাঘব হইল ; মনুষ্যমাত্র প্রেমের পত্র হইল ; পৃথিবী সৎকৰ্ম্মের জন্য মাত্র স্বঠ বোধ হইতে লাগিল । সকলু সংসার সুন্দর বোধ হইতে লাগিল । প্রণয় এইরূপ । প্রণয় কর্কশকে মধুর করে, অসৎকে সৎ করে, অপু ণ্যকে পুণ্যবান করে, অন্ধকারকে আলোকময় করে । আর কপালকুণ্ডল ? তাহার কি ভাব ? চল পাঠক, তাহাকে দর্শন করি । ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ অবরোধে “কিমিত্যুপাস্তাভরণানি যৌবনে ধৃতং ত্বয়া বাৰ্দ্ধকশোভিবষ্কলম্। বদ প্রদোষে ফুটচন্দ্রতারকা বিভাবরী যদ্যরুণায় কল্পতে ॥” –কুমারসম্ভব । সকলেই অবগত আছেন যে, পুৰ্ব্বকালে সপ্তগ্রাম মহাসমৃদ্ধিশালিনী নগরী ছিল । এককালে ঘবদ্বীপ বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী হইতে রোমক পৰ্য্যন্ত সৰ্ব্বদেশের বণিকেরা বাণিজ্যার্থ এই মহানগরীতে মিলিত হইত; কিন্তু বঙ্গীয় দশম একাদশ শতাব্দীতে সপ্তগ্রামের প্রাচীন সমৃদ্ধির লাঘব জন্মিয়াছিল । ইহার প্রধান কারণ এই যে, তন্নগরীর প্রাস্তভাগ প্রক্ষালিত করিয়া যে স্রোতস্বতী বাহিত হইত, এক্ষণে তাহা সঙ্কীর্ণশরীরা হইয়। আসিতেছিল, সুতরাং বৃহদাকার জলযান সকল আর নগরী পর্য্যন্ত আসিতে পারিত না । এ কারণ বাণিজ্যবাহুল্য ক্রমে লুপ্ত হইতে লাগিল । বাণিজ্যগৌরব নগরীর বাণিজ্যনাশ হইলে সকলই যায় । সপ্তগ্রামের সকলই গেল। বঙ্গীয় একাদশ শতাব্দীতে হুগলী নুতন সৌষ্ঠবে তাহার প্রতিযোগী হইয়া উঠিতেছিল। তথায় পৰ্ত্ত গীসের বাণিজ্য আরম্ভ করিয়া সপ্তগ্রামের ধনলক্ষ্মীকে আকৰ্ষিত করিতেছিলেন । কিন্তু তখনও সপ্তগ্রাম একেবারে হতশ্ৰী হয় নাই। তথায় এ পর্য্যস্ত ফৌজদার প্রভৃতি প্রধান রাজপুরুষদিগের বাস ছিল ; কিন্তু নগরীর অনেকাংশ ঐশ্রষ্ট এবং বসতিহীনা হইয়। পল্লীগ্রামের আকার ধারণ করিয়াছিল । সপ্তগ্রামের এক নির্জন ঔপনগরিক ভাগে নবকুমারের বাস । এক্ষণে সপ্তগ্রামের ভগ্নদশায় তথtয় প্রায় মনুষ্যসমাগম ছিল না ; রাজপথ সকল লতাগুল্মদিতে পরিপূরিত হইয়াছিল । নবকুমারের বাটীর পশ্চাদ্ভাগেই এক বিস্তৃত নিবিড় বন । বাটীর সন্মুখে প্রায় ক্রোশাদ্ধ দূর একটি ক্ষুদ্র খাল বৰ্হিত; সেই খাল একটা ক্ষুদ্র প্রাস্তর বেষ্টন করিয়া গৃহের পশ্চাদ্ভাগস্থ বনমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল । গৃহটি ইষ্টকরচিত ; দেশকল বিবেচনা করিলে তাঁহাকে নিতান্ত সামাষ্ঠ গৃহ বলা যাইতে পারিত না । দোতলা বটে, কিন্তু ভয়ানক উচ্চ নহে, এখন একতলায় সেরূপ উচ্চতা অনেক দেখা যায় । এই গৃহের সৌধোপরি দুইটি নবীনবয়সী স্ত্রীলোক দাড়াইয়। চতুৰ্দ্দিকৃ অবলোকন করিতেছিলেন। সন্ধ্যাকাল উপস্থিত । চতুর্দিকে যাহা দেখা যাইতেছিল, তাহা লোচনরঞ্জক বটে। নিকটে এক দিকে নিবিড় বন ; তন্মধ্যে অসংখ্য পক্ষী কলরব করিতেছে । অন্যদিকে ক্ষুদ্র খাল, রূপার স্থতার দ্যায় পড়িয়া রহিয়াছে। দুরে মহানগরীর অসংখ্য সৌধমালা নববসন্তপবনস্পর্শ লোলুপ নাগরিকগণে পরিপূরিত হইয়া শোভা পাইতেছে । অন্ত দিকে, অনেক দূরে নৌকাভরণা ভাগীরথীর বিশাল বক্ষে সন্ধ্যাতিমির ক্ষণে ক্ষণে গাঢ়তর হইতেছে । যে নবীনাদ্বয় প্রাসাদোপরি দাড়াইয়াছিলেন, তন্মধ্যে এক জন চন্দ্ররশ্মিবৰ্ণাভ ; আবিস্তস্ত কেশভারমধ্যে