পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কপালকুণ্ডল ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ চরণতলে "কামু মনঃ প্রাণ অামি সঁপিব তোমারে । ভুঞ্জ আলি রাজভোগ দাসীর আলয়ে ।” --বীরাঙ্গন কাব্য । ক্ষেত্রে বীজ রোপিত হইলে আপনিই অঙ্কুর হয়। যখন অঙ্কুর হয়, তখন কেহ জানিতে পারে না—কেহ দেখিতে পায় না। কিন্তু একবার বীজ রোপিত হইলে, রোপণকারী যথায় থাকুক না কেন, ক্রমে অঙ্কুর হইতে বৃক্ষ মস্তকোন্নত করিতে থাকে। অদ্য বৃক্ষটি অঙ্গুলিপরিমেয় মাত্র, কেহ দেখিয়াও দেখিতে পায় না । ক্রমে তিল তিল বৃদ্ধি। ক্রমে বৃক্ষটি অৰ্দ্ধহস্ত, একহস্ত, দুইহস্ত পরিমাণ হইল ; তথাপি, যদি তাহাতে কাহারও স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা না রহিল, তবে কেহ দেখে না, দেখিয়াও দেখে না । দিন যায়, মাস যায়, বৎসর যায়, ক্রমে তাহার উপর চক্ষু পড়ে। আর অমনোযোগের কথা নাই,—ব্রুমে বৃক্ষ বড় হয়, তাহার ছায়ায় অন্ত বৃক্ষ নষ্ট করে,—চাহি কি, ক্ষেত্র অনন্তপাদপ হয় । লুৎফউন্নিসার প্রণয় এইরূপ বাড়িয়াছিল। প্রথম এক দিন অকস্মাৎ প্রণয়ভাজনের সহিত সাক্ষাৎ হইল, তখন প্রণয়সঞ্চার বিশেষ জানিতে পারিলেন না । কিন্তু তখনই অঙ্কুর হইয়। রহিল । তাহার পর আর সাক্ষাৎ হইল না । কিন্তু অসাক্ষাতে পুনঃ পুনঃ সেই মুখমণ্ডল মনে পড়িতে লাগিল, স্মৃতিপটে সে মুখমণ্ডল চিত্রিত করা কতক কতক সুখকর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল । বীজে অঙ্কুর জন্মিল। মূৰ্ত্তিপ্রতি অনুরাগ জন্মিল। চিত্তের ধৰ্ম্ম এই যে, যে মানসিক কৰ্ম্ম যত অধিক বার করা যায়, সে কৰ্ম্মে তত অধিক প্রবৃত্তি হয় ; সে কৰ্ম্ম ক্রমে স্বভাবসিদ্ধ হয় ; লুৎফউন্নিসা সেই মূৰ্ত্তি অহরহ মনে ভাবিতে লাগিলেন। দারুণ দর্শনাভিলাষ জন্মিল ; সঙ্গে সঙ্গে তাহার সহজপূহপ্রবাহও ঘনিবাৰ্য্য হইয়া উঠিল। দিল্লীর সিংহাসন লালসাও তাহার নিকট লঘু হইল। সিংহাসন যেন মন্মথশরসভূত অগ্নিরাশিবেষ্টিত বোধ হইতে লাগিল । রাজ্য, রাজধানী, রাজসিংহাসন সকল বিসর্জন দিয়৷ প্রিয়জনসনদর্শনে ধাবিত হইলেন । সে প্রিয়জন | এই জন্তই লুৎফউন্নিসা মেহের-উন্নিসার আশ+ নাশিনী কথা শুনিয়াও অসুখী হয়েন নাই ; এই জন্যই ৩য়—২৩ ‘Lට්) আগ্ৰায় আসিয়া সম্পদরক্ষায় কোন যত্ন পাইলেন না ; এই জন্তই জন্মের মত বাদশাহের নিকট বিদায়: লইলেন । লুৎফউন্নিসা সপ্তগ্রামে আসিলেন । রাজপথের অনতিদূরে নগরীর মধ্যে এক অট্টালিকায় আপন বাসস্থান করিলেন । রাজপথের পথিকেরা দেখিলেন, অকস্মাৎ এই অট্টালিকা সুবর্ণ-খচিতবসনভূষিত দাসদাসীতে পরিপূর্ণ হইয়াছে। কক্ষায় কক্ষায় হুৰ্ম্মসজ্জা অতি মনোহর । গন্ধদ্রব্য, গন্ধবারি, কুমুমদাম সৰ্ব্বত্র তামোদ করিতেছে। স্বর্ণ, রৌপ্য, গজদস্তাদি-খচিত গৃহশোভার্থ নানান্দ্রব্য সকল স্থানেই অtলো করিতেছে । এইরূপ সজ্জীভূত এক কক্ষায় লুৎফউল্লিস। অধোবদনে বসিয়া আছেন ; পৃথগাসনে নবকুমার বসিয়া আছেন। সপ্তগ্রামে নবকুমারের সহিত লুৎফউন্নিসার আর দুই একবার সাক্ষাৎ হইয়াছিল ; তাহাতে লুৎফউন্নিসার মনোরথ কতদূর সিদ্ধ হইয়াছিল, তাহা অদ্যকার কথায় প্রকাশ হুইবে । নবকুমার কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া কহিলেন, “তবে আমি এক্ষণে চলিলাম। তুমি আর আমাকে ডাকিও ন! ” লুৎফউরিস কহিলেন, “যাইও না। আর একটু থাক । আমার যাহা বক্তব্য, তাহ সমাপ্ত করি নাই ।” : নবকুমার আরও ক্ষণেক প্রতীক্ষা করিলেন, কিন্তু লুৎফউল্লিস। কিছু বলিলেন না । ক্ষণেক পরে নবকুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর কি বলিবে ?” লুৎফউন্নিসা কোন উত্তর করিলেন না—তিনি নীরবে রোদন করিতেছিলেন । নবকুমার ইহ দেখিয়া গাত্ৰোখান করিলেন, লুৎফউন্নিসা তাহার বস্ত্রাগ্র ধৃত করিলেন। নবকুমার ঈষৎ বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “কি বল না ?” লুৎফউন্নিস কহিলেন, “তুমি কি চাও? পৃথিবীতে কিছু কি প্রার্থনীয় নাই ? ধন, সম্পদ, মান, প্রণয়, রঙ্গ, রহস্ত পৃথিবীতে ষাহাকে যাহাকে সুখ বলে, সকলই দিব, কিছুই তাহার প্রতিদান চাহি না ; কেবল তোমার দাসী হইতে চাহি । তোমার যে পত্নী হইব, এ গৌরবও চাহি না, কেবল দাসী !” নবকুমার কহিলেন, “আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, ইহজন্মে দরিদ্র ব্রাহ্মণই থাকিব । তোমার দত্ত ধনসম্পদ লইয়। ষবনী-জার হইতে পারিব না ।” যবনী-জার!—নবকুমার এ পর্য্যস্ত জানিতে পারেন নাই যে, এই রমণী তাহার পত্নী। লুৎফউন্নিসা অধোবদনে রহিলেন । নবকুমার তাহার হস্ত হইতে বস্ত্রাগ্রভাগ মুক্ত করিলেন। লুৎফউল্লিস। আবার