পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8o বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী শয়ন করিলেন, কিন্তু নিদ্র। আসিল না। প্রবলবায়ু তড়িত বারিধারাপরিধিঞ্চিত জটাজুটুবেষ্টিত সেই মুখমণ্ডল অন্ধকারমধ্যেও চতুর্দিকে দেখিতে লাগিলেন, কপালকুণ্ডল৷ পূৰ্ব্ববৃত্তান্ত সকল আলোচনা করিয়া দেখিতে লাগিলেন, কাপালিকের সহিত ষেরূপ আচরণ করিয়া তিনি চলিয়া আসিয়াছিলেন, তাহ স্মরণ হইতে লাগিল ; কাপালিক নিবিড় বনমধ্যে যে সকল পৈশাচিক কাৰ্য্য করিতেন, তাহা স্মরণ হইতে লাগিল ; তৎকৃত ভৈরবীপূজা, নবকুমারের বন্ধন, এ সকল মনে পড়িতে লাগিল। কপালকুণ্ডল। শিহরিয়া উঠিলেন। অন্ধকার রাত্রে সকল ঘটনাও মনোমধ্যে আসিতে লাগিল । শুামার ঔষধিকামনা, নবকুমারের নিষেধ, তাহার প্রতি কপালকুণ্ডলার তিরস্কার, তৎপরে অরণ্যের জ্যোৎস্নামী শোভা, কাননতলে অন্ধকার, সেই অরণ্যমধ্যে যে সহচর পাইয়াছিলেন, তাহার ভীমকান্তগুণময় রূপ : সকলই মনে পড়িতে লাগিল । পূৰ্ব্বদিকে উষার মুকুটজ্যোতিঃ প্রকটত হইল ; তখন কপালকুণ্ডলার অল্প তন্দ্র। আসিল । সেই অপ্রগাঢ় নিদ্রায় কপালকুণ্ডল স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন । তিনি যেন সেই পূৰ্ব্বদৃষ্ট সাগরস্থদয়ে তরণী আরোহণ করিয়া যাইতেছিলেন । তরণী মুশোভিত ; তাহাতে বসন্তরঙ্গের পতাকা উড়িতেছে ; নাবিকেরা ফুলের মাল গলায় দিয়া বাহিতেছে। রাধাপ্তামের অনন্ত প্রণয়গীত করিতেছে । পশ্চিমগগন হইতে স্বৰ্য্য স্বর্ণধারা বৃষ্টি করিতেছে। স্বর্ণধার। পাইয়া সমুদ্র হাসিতেছে ; আকাশমণ্ডলে মেঘগণ সেই স্বর্ণবৃষ্টিতে দুটাছুটি করি। স্নান করিতেছে। অকস্মাৎ রাত্রি হুইল, সূৰ্য্য কোথায় গেল । স্বর্ণমেঘ সকল কোথায় গেল। নিবিড় নীল কাদম্বিনী আসিয়। আকাশ ব্যাপিয়া ফেলিল । আর সমুদ্রে দিক্ নিরূপণ হয় না। নাবিকের তরী ফিরাইল । কোন দিকে বাহিবে, স্থিরতা পায় না। তাহারা গাঁত বন্ধ করিল, গলার মালা সকল ছিড়িয়া ফেলিল । বসন্তরঙ্গের পতাক৷ আপনি খসিয়া জলে পড়িয়া গেল । বাতাস উঠিল ; বৃক্ষপ্রমাণ তরঙ্গ উঠিতে লাগিল, তরঙ্গমধ্য হইতে একজন জটাজুটধারী প্রকাণ্ডাকার পুরুষ আসিয়া কপালকুণ্ডলার নৌক৷ বামহস্তে তুলিয়৷ সমুদ্রমধ্যে প্রেরণ করিতে উদ্যত হইল। এমন সময়ে সেই ভীমকান্তীময় ব্রাহ্মণবেশধারী আসিয়া তরী ধরিয়া রহিল । সে কপালকুণ্ডলাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমায় রাখি কি নিমগ্ন করি ?” অকস্মাৎ কপালকুণ্ডলার মুখ হইতে বাহির হইল, “নিমগ্ন কর।” ব্রাহ্মণবেশী নৌকা ছাড়িয়া দিল । তখন নৌকাও শব্দময়ী হইল, কথা কহিয়া উঠিল। নৌকা কহিল, “আমি আর এ ভার বহিতে পারি না, আমি পাতালে প্রবেশ করি।” ইহা কহিয়া নৌকা তাহাকে জলে নিক্ষিপ্ত করিয়া পাতালে প্রবেশ করিল। ঘৰ্ম্মাক্তকলেবর হইয়া কপালকুণ্ডল স্বপ্নোখিত হইলে চক্ষুরুন্মীলন করিলেন ; দেখিলেন, প্রভাত হইয়াছে, কক্ষার গবাক্ষ মুক্ত রহিয়াছে, তন্মধ্য দিয়া বসন্তবায়ুস্রোতঃ প্রবেশ করিতেছে । মন্দান্দোলিত বৃক্ষশাখায় পক্ষিগণ কুঞ্জন করিতেছে । সেই গবাক্ষের উপর কতকগুলি মনোহর বন্য লতামুবাসিত কুমুমসহিত দুলিতেছে "কপালকুণ্ডল নারীস্বভাববশতঃ লতাগুলি গুছাইয়া লইতে লাগিলেন ; তাহা সুশৃঙ্খল করিয়া বাধিতে বাধিতে তাহার মধ্য হইতে একখানি লিপি বাহির হইল। কপালকুণ্ডলা অধিকারীর ছাত্র, পড়িতে পারিতেন । নিম্নোক্তমত পাঠ করিলেন— “অদ্য সন্ধ্যার পর কল্য রাত্রের ব্রাহ্মণকুমারের সহিত সাক্ষাৎ করিব । তোমার নিজ সম্পৰ্কীয় নিতান্ত প্রয়োজনীয় যে কথা শুনিতে চাহিয়াছিলে, তাহা শুনিবে । অহং ব্রাহ্মণবেশী।” চতুর্থ পরিচ্ছেদ কুতসঙ্কেতে té —I will have grounds More relative than this.” —Hamlet. কপালকুণ্ডল সে দিন সন্ধ্যা পর্য্যন্ত অনন্তচিন্ত৷ হইয়। কেবল ইহাই বিবেচনা করিতেছিলেন যে, ব্রাহ্মণবেশীর সহিত সাক্ষাৎ বিধেয় কি না। পতিব্ৰতা যুবতীর পক্ষে রাত্রিকালে নির্জনে অপরিচিত পুরুষের সহিত সাক্ষাৎ যে অবিধেয়, ইহা ভাবিয়া তাহার মনে সঙ্কোচ জন্মে নাই ; তদ্বিষয়ে তাহার স্থিরসিদ্ধান্তই ছিল যে, সাক্ষাতের উদেখ দুস্ত না হইলে এমন সাক্ষাতে দোষ নাই—পুরুষে পুরুষে বা স্ত্রীলোকে স্ত্রীলোকে যেরূপ সাক্ষাতের অধিকার, স্ত্রী-পুরুষে সাক্ষাতের উভয়েরই সেইরূপ অধিকার উচিত বলিয়া তাহার বোধ ছিল ; বিশেষ ব্রাহ্মণবেশী পুরুষ কি না, তাহাতে সন্দেহ । সুতরাং সে সঙ্কোচ অনাবগুক ; কিন্তু এ সাক্ষাতে মঙ্গল কি অমঙ্গল জন্মিবে, তাহাই