পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ক্রিতীচ্ছন্ন খণ্ড প্রথম পরিচ্ছেদ ' ' পাচে পাচে দশ বৎসর অতীত হইয় গেল । যে দিন প্রফুল্লকে বাগদীর মেয়ে বলিয়া হরবল্লভ তাড়াইয়া দিয়াছিল, সে দিন হইতে দশ বৎসর হইয়া গিয়াছে। এই দশ বৎসর হরবল্লভ রায়ের পক্ষে বড় ভাল গেল না । দেশের কুর্দশার কথা পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি । ইজারাদার দেবীসিংহের অত্যাচার, তার উপরে ডাকাইতের অত্যাচার। একবার হরবল্লভের তালুক হইতে টাকা চালান আসিতেছিল, ডাকাইতে তাহা লুঠিয়া লইল । সেবার দেবীসিংহের খাজানা দেওয়া হইল না। দেবীসিংহ একখান। তালুক বেচিয়া লইল । দেবীসিংহের বেচিয় লওয়ার প্রথা মন্দ ছিল না । হেষ্টিংস সাহেব ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের রূপায় সকল সরকারী কৰ্ম্মচারী দেবীসিংহের আজ্ঞাবহ, বেচাকেনা সম্বন্ধে সে যাহা মনে করিত, তাহাই হইত। হরবল্লভের দশ হাজার টাকার মূল্যের তালুকখান আড়াই শত টাকায় দেবীসিংহ নিজে কিনিয়া লইলেন । তাহাতে বাকী খাজান কিছুই পরিশোধ হইল না, দেনার জের চলিল । দেবীসিংহের পীড়াপীড়িতে, কয়েদের আশঙ্কায় হরবল্লভ আর একটা সম্পত্তি বন্ধক দিয়া ঋণ পরিশোধ করিলেন । এই সকল কারণে y:জায় বড় কমিয়া আসিল ; কিন্তু ব্যয় কিছুষ্ট কমিল না—বুনিয়াদি চাল খাটো করা যায় না। সকল লোকেরই প্রায় এমন ন! এমন একদিন উপস্থিত হয়, যখন লক্ষ্মী আসিয়া বলেন, “হয় সাবেক চাল ছাড়–নয় আমায় ছাড় ।” অনেকেই উত্তর দেন, *মা, তোমায় ছাড়িলাম, চাল ছাড়িতে পারি না ।” হুরবল্লভ তাহারই এক জন । দোল-দুর্গোৎসব,ক্রিয়াকৰ্ম্ম, দানধ্যান, লাঠালাঠি পূৰ্ব্বমতই হইতে লাগিল— বরং ডাকাইতে চালান লুঠিয়া লওয়া অবধি লাঠিয়ালের খরচটা কিছু বাড়িয়ছিল । খরচ আর কুলায় না । কিস্তি কিস্তি সরকারী খাজান বাকী পড়িতে লাগিল। বিষয়-আশয় যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাহাও বিক্রয় হইয়া যায়, আর থাকে না । দেনার উপর দেন৷ হইল, মুদে আসল ছাপাইয়া উঠিল—টাক। আর ধার পাওয়া যায় না । এ দিকে দেবীসিংহের পাওন। প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা বাকী পড়িল ; হরবল্লভ কিছুতেই টাকা দিতে

  • .

পারেন নী—শেষে হরবল্লভ রায়কে গ্রেপ্তার করিবার জন্য পরোয়ান বাহির হইল। তখনকার গ্রেপ্তারি পরোয়নার জন্য বড় আইন-কানুন খুজিতে হুইত না, তখন ইংরেজের আইন হয় নাই। সব তখন বে-আইন । ബ %, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ বড় ধূম পড়িয়াছে। ব্রজেশ্বর শ্বশুরবাড়ী আসিয়াছেন । কোন শ্বশুরবাড়ী, তাহা বলা বাহুল্য । সাগরের বাপের বাড়ী । তখনকার দিনে একটা জামাই আসা বড় সহজ ব্যাপার ছিল না । তাতে আবার এজেশ্বর শ্বশুরবাড়ী সচরাচর আসেন না । পুকুরে পুকুরে, মাছমহলে ভারি হুটাহুটি, ছুটাছুটি পড়িয়া গেল । জেলের দৌরাত্ম্যে প্রাণ অার রক্ষা হয় না। জেলেমাগীদের ইঁাটাইটিতে পুকুরের জল কালী হইয়া যাইতে লাগিল। মাছ চুরির আশায় ছেলেরা পাঠশালা ছাড়িয় দিল । দই, দুধ, ননী, ছানা, সর, মাখনের ফরমাইসের জালায় গোয়ালার মাথা বেঠিক হইয়া উঠিল ; সে কখন এক সের জল মিশাইতে তিন সের জল মিশাইয়া ফেলে, তিন সের মিশাইতে এক সের মিশাইয় বসে। কাপড়ের ব্যাপারীর কাপড়ের মোট লইয়। ষাতায়াত করিতে করিতে পায় ব্যথা হইয়া গেল ; কাহারও পছন্দ হয় না, কোন ধুতি চাদর কে জামাইকে দিবে। পাড়ার মেয়েমহলে বড় হাঙ্গামা পড়িল যাহার যাহা গহন। আছে, তারা সে সকল সারাইতে, মাঞ্জিতে, ঘসিতে, নুতন করিয়া গাথাইতে লাগিল । যাহাঁদের গহনা নাই, তাহারা চুড়ি কিনিয়া, শাখা কিনিয়া, সোনারূপ চাহিয়া-চিন্তিয়া এক রকম বেশভূষার যোগাড় করিয়া রাখিল—নহিলে জামাই দেখিতে যাওয়া হয় না । যাহাদের রসিকতার জন্য পসার আছে—তাহারা দুই চারিট প্রাচীন তামাসা মনে মনে ঝালাইয়া রাখিলেন ; যাহাদের পসার নাই, তাহারা চোরাই মাল পাচার করিবার চেষ্টায় রহিল। কথার তামাস। পরে হবে— খাবার তামাসা আগে । তার জন্ত ঘরে ঘরে কমিটী বসিয়া গেল। বহুতর কৃত্রিম আহাৰ্য্য, পানীয়, ফল-মূল প্রস্তুত হইতে লাগিল। মধুর অধরগুলি মধুর হাসিতে ও সাধের মিশিতে ভরিয়া যাইতে লাগিল ।