পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেবী চৌধুরাণী নিশি । আমি ভাই বৈষ্ণবী, তৈজসের ধার ধারি না—আমাদের দোঁড় মালস পর্য্যন্ত | তৈজসের খবর সাগরকে জিজ্ঞাসা কর । সাগর। আমি ঠিক কথা জানি । পুরুষমানুষ তৈজসের মধ্যে কলসী সদাই অস্তঃশূন্ত—আমরা যাই গুণবতী, তাই জল পুরিয়া পূর্ণকুম্ভ করিয়া রাখি। নিশি বলিল, “ঠিক বলিয়াছিস, তাই মেয়েমানুষে এ জিনিস গলায় বাধিয়া সংসার সমুদ্রে ডুবিয়া মরে— নে ভাই, তোর কলসী কলসী-পীড়ির উপর তুলিয়া রাখ, ” ব্র । কলসী মানে মানে আপন পীড়ির উপর উঠিতেছে । এই কথা বলিয়া ব্ৰজেশ্বর আপনি মসনদের উপর উঠিয়া বসিল । হঠাৎ দুই দিক হইতে দুই জন পরিচারিকা—সুন্দরী যুবতী, বহুমূল্য বসনভূষণভূষিতা—দুইট। সোণাবাধা চামর হাতে করিয়া, ব্ৰজেশ্বরের দুই পাশ্বে আসিয়া দাড়াইল । আজ্ঞা ন। পাইয়াও তাহারা ব্যজন করিতে লাগিল । নিশি তখন সাগরকে বলিল, “যা, এখন তোর স্বামীর জন্য আপন হাতে তামাকু সাজিয়া লইয়া অায় ।” সাগর ক্ষিপ্ৰহস্তে, সোণার আলবোলার উপর হইতে কলিকা লইয়া গিয়া শীঘ্ৰ মৃগনাভি-মুগন্ধি তামাকু সাজিয়া আনিল ; আলবোলায় চড়াইয়৷ দিল । ব্ৰজেশ্বর বলিল,—“আমাকে একটা হু কায় নল করিয়া তামাকু দাও।” নিশি বলিল,—“কোন শঙ্কা নাই—ঐ আলবোলা উৎস্থই নয় । কেহ কখন উহাতে তামাকু খায় নাই । আমরা কেহ তামাকু খাই না।” ত্র । সে কি ? তবে এ আলবোলা কেন ? নিশি । দেবীর রাণীগিরির দোকানদারি— ব্র । তা হোঁক-আমি যখন আসিলাম, তখন যে তামাকু সাজা ছিল—কে খাইতেছিল ? নিশি । কেহ না—সাজাও দোকানদারি । ঐ আলবোলা সেই দিন বাহির হইয়াছে--ঐ তামাকু সেই দিন কেনা হইয়া আসিয়াছে—সাগরের স্বামী আসিবে বলিয়া । ব্রজেশ্বর মুখনলটি পরীক্ষা করিয়া দেখিল—অভুক্ত বোধ হয় । তখন ব্রজেশ্বর ধূমপানের অনিৰ্ব্বচনীয় মুখে মগ্ন হইল। তখন নিশি সাগরকে বলিল, “তুই পোড়ারমুখী, আর দাড়াইয়া কি করিস? পুরুষমামুষে হুকার নল মুখে করিলে আর কি স্ত্রীপরিবারকে মনে ঠাই দেয় ? যা, তুই গোটাকত পান সাজিয়া আন । দেখিস, আপন হাতে ૭-૭૧ 8 S পান সাজিয়া আনিস্—পরের সাজা আনিস না— পারিস যদি, একটু ওষুধ করিস।” সাগর বলিল, “আপন হাতেই সাজা আছে—ওষুধ জানিলে আমার এমন দশা হইবে কেন ?” এই বলিয়া সাগর চন্দন কপূরচুয়াগোলাবে মুগন্ধি পানের রাশি সোনার বাটা পূরিয়া আনিল । তখন নিশি বলিল, “তোর স্বামীকে অনেক বকেছিল, কিছু জলখাবার নিয়ে অায় ।” ব্ৰজেশ্বরের মুখ শুকাইল, বলিল, “সৰ্ব্বনাশ! এত রাত্রে জলখাবার । ঐটি মাপ করিও ।” কিন্তু কেহ তাহার কথা শুনিল না—সাগর বড় তাড়াতাড়ি আর এক কামরায় বীট দিয়া, জলের হাতে মুছিয়া, একখানা বড় ভারি পুরু আসন পাতিয়া চারি পাঁচখানা রূপার থালে সামগ্রী সাজাইয়া ফেলিল । স্বর্ণপাত্রে উত্তম সুগন্ধি শীতল জল রাখিয়া দিল । জানিতে পারিয়া নিশি ব্ৰজেশ্বরকে বলিল, “ঠাই হইয়াছে—উঠ ৷” ব্রজেশ্বর উকি মারিয়া দেখিয়া নিশির কাছে ষোড়হাত করিল । বলিল,—“ডাকাইতি করিয়া ধরিয়া আনিয়া কয়েদ করিয়াছ—সে অত্যাচার সহিয়াছে । কিন্তু এত রাত্রে এ অত্যাচার সহিবে না—দোহাই!” স্ত্রীলোকেরা মার্জনা করিল না। ব্রজেশ্বর অগত্য কিছু খাইল । সাগর তখন নিশিকে বলিল, “ব্রাহ্মণভোজন করাইলে কিছু দক্ষিণা দিতে হয় ।” নিশি বলিল, "দক্ষিণ রাণী স্বয়ং দিবেন, এসো ভাই, রাণী দেখিবে এসে " এই বলিয়া নিশি ব্রজেশ্বরকে আর এক কামরায় সঙ্গে করিয়া লইয়া গেল । অষ্টম পরিচ্ছেদ নিশি ব্রজেশ্বরকে সঙ্গে করিয়া দেবীর শষ্যাগৃহে লইয়া গেল। ব্রজেশ্বর দেখিলেন, শয়নঘর দরবারের কামরার মত অপূৰ্ব্ব সজ্জায় সজ্জিত। বেশীর ভাগ একখানা সুবর্ণমণ্ডিত মুক্তার ঝালরযুক্ত ক্ষুদ্র পালঙ্ক আছে। কিন্তু ব্ৰজেশ্বরের সে সকল দিকে চক্ষু ছিল না। এত ঐশ্বর্য্যের অধিকারিণী প্রথিতনামী দেবীকে দেখিবেন । দেখিলেন, কামরার ভিতর অনাবৃত কাষ্ঠের উপর বসিয়া অৰ্দ্ধাবগুণ্ঠনবতী একটি স্ত্রীলোক । নিশি ও সাগরে, ব্রজেশ্বর যে চাঞ্চল্যময়ত দেখিয়াছিল, ইহাতে তাহার কিছুই নাই । এ স্থির, ধীর, নিম্নদৃষ্টি—লজ্জাবনতমুখী। নিশি ও সাগর, বিশেষতঃ নিশি সৰ্ব্বাঙ্গে রত্নালঙ্কারমণ্ডিত, বহুমূল্য বসনে