পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেবী চৌধুরাণী সাগর কাতর হইয়া অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করিল। কিছুই উত্তর পাইল না। একবার ব্রজেশ্বর বলিল, “প্ৰফুল্ল ডাকাত ! ছি!” या् দশম পরিচ্ছেদ ব্ৰজেশ্বর ও সাগরকে বিদায় দিয়া দেবী চৌধুরাণী —হায়! কোথায় গেল দেবী ? কই সে বেশভূষা, ঢাকাই সাড়ী, সোনাদান, হীরা, মুক্তা, পান্না—সব কোথায় গেল? দেবী সব ছাড়িয়াছে—সব একেবারে অস্তধান হইয়াছে। দেবী কেবল একখানা গড় পরিয়াছে, হাতে কেবল একগাছ কড় । দেবী নৌকার এক পাশে বজরার শুধু তক্তার উপর একখানা চট পাতিয়া শয়ন করিল । ঘুমাইল প্রভাতে বজরা বাঞ্ছিত স্থানে আসিয়া লাগিয়াছে দেখিয়া, দেবী নদীর জলে নামিয়া স্নান করিল। স্নান করিয়া ভিজা কাপড়েই রহিল—সেই চটের মত মোট সাড়ী ৷ কপাল ও বুক গঙ্গামূত্তিকায় চর্চিত করিল —রুক্ষ, ভিজা চুল এলাইয়া দিল—তখন দেবীর যে সৌন্দর্য্য বাহির হইল,গত রাত্রের বেশভূষা, জাকজমক, হীরা, মতি, চাদনী বা রাণীগিরিতে তাহা দেখা যায় নাই । কা’ল দেবীকে রত্নাভরণে রাজরাণীর মত দেখাইয়াছিল—আজ গঙ্গামৃত্তিকার সজ্জায় দেবতার মত দেখাইতেছে । ষে সুন্দর, সে মাটী ছাড়িয়া হীরা পরে কেন ? দেবী এই অনুপম বেশে এক জন মাত্র স্ত্রীলোক সমভিব্যাহারে লক্টয়া তীরে তীরে চলিল-—বজরায় উঠিল না। এরূপ অনেক দূর গিয়া একটা জঙ্গলে প্রবেশ করিল । আমরা কথায় কথায় জঙ্গলের কথা বলিতেছি—কথায় কথায় ডাকাইতের কথা বলিতেছি,—ইহাতে পাঠক মনে করিবেন না, আমরা কিছুমাত্র অত্যুক্তি করিতেছি, অথবা জঙ্গল বা ডাকাইত ভালবাসি । যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে সে দেশ জঙ্গলে পরিপূর্ণ। এখনও অনেক স্থানে .ভয়ানক জঙ্গল—কতক কতক আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি । আর ডাকাইতের ত কথাই নাই । পাঠকের স্মরণ থাকে যেন যে, ভারতবর্ষের ডাকাইত শাসন করিতে মাবৃকুইস অব হেষ্টিংসকে ষত বড় যুদ্ধোদ্যম করিতে হইয়াছিল, পঞ্জাবের লড়াইয়ের পূৰ্বে আর কখন তত করিতে হয় নাই। இ. এ সকল অরাজকতার সময়ে ডাকাইতিই ক্ষমতাশালী লোকের ব্যবসা ছিল। যাহারা দুৰ্ব্বল বা গণ্ডমূর্খ, তাহারাই “ভাল মানুষ" হইত। ডাকাইতিতে তখন কোন নিন্দ বা লজ্জা ছিল না । দেবী জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিয়া অনেক দুর গেল। একটা গাছের তলায় পৌঁছিয়া পরিচারিকাকে বলিল,-“দিবা, তুই এখানে বস। আমি আসিস্ট্রে। এ বনে বাঘ-ভালুক বড় অল্প । আসিলেও তোর ভয় নাই । লোক পাহারায় আছে।” এই বলিয়। দেবী সেখান হইতে আরও গাঢ়তর জঙ্গলমধ্যে প্রবেশ করিল। অতি নিবিড় জঙ্গলের ভিতর একটা সুড়ঙ্গ । পাথরের সিড়ি আছে । যেখানে নামিতে হয়, সেখানে অন্ধকার—পাথরের ঘর। পূৰ্ব্বকালে বোধ হয় দেবালয় ছিল—এক্ষণে কালসহকারে চারিপাশে মাটী পড়িয়া গিয়াছে। কাজেই তাহাতে নামিবার সিঁড়ি গড়িবার প্রয়োজন হইয়াছে । দেবী অন্ধকার সিঁড়িতে নামিল । সেই ভূগর্ভস্থ মন্দিরে মিট মিটু করিয়া একটা প্রদীপ জ্বলিতেছিল । তার আলোতে এক শিবলিঙ্গ দেখা গেল ! এক ব্রাহ্মণ সেই শিবলিঙ্গের সম্মুখে বসিয়া র্তাহার পূজা করিতেছিল। দেবী শিবলিঙ্গকে প্রণাম করিয়া, ব্রাহ্মণের কিছু দূরে বসিলেন। ব্রাহ্মণ পূজা সমাপন পূর্বক আচমন করিয়া দেবীর সঙ্গে কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইল । ব্রাহ্মণ বলিল, “মা ! কাল রাত্রে তুমি কি করিয়াছ ? তুমি কি ডাকাইতি করিয়াছ না কি ?” দেবী বলিল, “আপনার কি বিশ্বাস হয় ?” ব্ৰাহ্মণ বলিল, “কি জানি ?" ব্রাহ্মণ আর কেহই নহে ; আমাদের পূর্বপরিচিত ভবানী ঠাকুর । দেবী বলিল, “কি জানি কি ঠাকুর ? আপনি কি অামায় জানেন না ? দশ বৎসর আজ এ দস্তু্যদলের সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইলাম। লোকে জানে, যত ডাকাইতি হয়, সব আমিই করি। তথাপি এক দিনের জন্য এ কাজ আমা হইতে হয় নাই—ত আপনি বেশ জানেন ; তবু বলেন, কি জানি ?” ভবানী । রাগ কর কেন ? আমরা যে অভিপ্রায়ে ডাকাইতি করি, তা মন্দ কাজ বলিয়। আমরা জানি না । তাহা হইলে, এক দিনের তরেও ঐ কাজ করিতাম না। তুমিও এ কাজ মন মনে কর না, বোধ হয় –কেন না, তাহা হইলে এ দশ বৎসর দেবী । সে বিষয়ে আমার মত ফিরিতেছে । আমি আপনার কথায় এত দিন ভুলিয়াছিলাম—জার