পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেবী চৌধুরাণী ব্রজ । ভুলে গিয়েছিলেম।. . ব্ৰহ্ম। তুই আমায় গঙ্গায় দিস নে । তুই বাগদী হয়েছিস । ব্রজ । ঠানদিদি ! চুপ, ও কথা না। ব্ৰহ্ম। তা দিস, পারিস ত গঙ্গায় দিস। আমি আর কথা কব না। কিন্তু ভাই, কেউ যেন আমার চরকা-টরক ভাঙ্গে না । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ কয়েক মাস থাকিয়া সাগর দেখিল, প্রফুল্ল যাহা বলিয়াছিল, তাহা করিল। সংসারের সকলকে সুখী করিল । শাশুড়ী প্রফুল্ল হইতে এত সুখী যে, প্রফুল্লের হাতে সমস্ত সংসারের ভার দিয়া, তিনি কেবল সাগরের ছেলে কোলে করিয়া বেড়াইতেন । ক্রমে শ্বশুরও প্রফুল্লের গুণ বুঝিলেন । শেষে প্রফুল্ল যে কাজ না করিত, সে কাজ তার ভাল লাগিত না । শ্বশুরশাশুড়ী প্রফুল্লকে না জিজ্ঞাসা করিয়া কোন কাজ করিতেন না, তাহার বুদ্ধি বিবেচনার উপর তাহাদের এতটাই শ্রদ্ধ হইল। ব্ৰহ্মঠাকুরাণীও রান্নাঘরের কর্তৃত্ব প্রফুল্লকে ছাড়িয়া দিলেন । বুড়ী আর বড় রাধিতে পারে না, তিন বউ রাধে ; কিন্তু যে দিন প্রফুল্ল দুই একখানা লা রাধিত, সে দিন কাহারও অন্ন-ব্যঞ্জন ভাল লাগিত না, যাহার ভোজনের কাছে প্রফুল্ল ন দাড়াইত, সে মনে করিত, আধপেট। খাইলাম ! শেষ নয়ান-বউও বশীভূত হইল। আর প্রফুল্লের সঙ্গে কোন্দল করিতে আসিত না । বরং প্রফুল্লের ভয়ে আর কাহারও সঙ্গে কোন্দল করিতে সাহস করিত না। প্রফুল্লর পরামর্শ ভিন্ন কোন কাজ করিত না । দেখিল, নয়নতারার ছেলেগুলিকে প্রফুল্ল যেমন যত্ন করে, নয়নতার তেমন পারে না । নয়নতার প্রফুল্লের হাতে ছেলেগুলি সমৰ্পণ করিয়া হইল । সাগর বাপের বাড়ী অধিক দিন থাকুিতে পারিল না—আবার আসিল। প্রফুল্লের কাছে থাকিলে সে যেমন সুখী হুইত, এত আর }কোথাও হুইত না । এ সকল অন্যের পক্ষে আশ্চৰ্য্য বটে, কিন্তু প্রফুল্লের পক্ষে আশ্চৰ্য্য নহে । কেন না, প্রফুল্ল নিষ্কাম ধৰ্ম্ম অভ্যাস করিয়াছিল। প্রফুল্প সংসারে আসিয়াই যথার্থ সন্ন্যাসিনী হইয়াছিল । তার কোন কামনা ছিল ন৷ —কেবল কাজ খুঁজিত। কামনা অর্থে আপনার মুখ రి = 58 વ૭ খোজ-কাজ অর্থে পরের সুখ খোজা । প্রফুল্প" নিষ্কাম অথচ কৰ্ম্মপরায়ণা, তাই প্রফুল্ল যথার্থ সন্ন্যাসিনী ; তাই প্রফুল্ল যাহা স্পর্শ করিত, তাই সোন হইত ; প্রফুল্ল ভবানী ঠাকুরের শাণিত অস্ত্র— সংসার-গ্রস্থি অনায়াসে বিচ্ছিন্ন করিল, অথচ কেহই হরবল্লভের গৃহে জানিতে পারিল না ষে, প্রফুল্ল এমন শাণিত অস্ত্র । সে যে অদ্বিতীয় মহামহোপাধ্যায়ের শিষ্যা—নিজে পরম পণ্ডিত—সে কথা দুরে থাক কেহ জানিল না যে, তাহার অক্ষরপরিচয়ও আছে। গৃহধৰ্ম্মে বিদ্যা-প্রকাশের প্রয়োজন নাই । গৃহধৰ্ম্ম বিদ্বানেই সুসম্পন্ন করিতে পারে বটে, কিন্তু বিদ্যা-প্রকাশের স্থান সে নয় । যেখানে বিদ্যাপ্রকাশের স্থান নহে, সেখানে যাহার বিদ্যা প্রকাশ পায়, সেই মুখ। যাহার বিদ্যা প্রকাশ পায় না, সেই যথার্থ পণ্ডিত । প্রফুল্লের যাহা কিছু বিবাদ, সে ব্রজেশ্বরের সঙ্গে । প্রফুল্ল বলিত, আমি এক তোমার স্ত্রী নহি । তুমি যেমন আমার, তেমনি সাগরের, তেমনি নয়ান-বউয়ের । আমি একা তোমায় ভোগ-দখল করিব না। স্ত্রীলোকের পতি দেবতা ; তোমাকে ওর। পূজা করিতে পায় না কেন ? ব্রজেশ্বর ত৷ শুনিত ন! ! রজেশ্বরের হৃদয় কেবল প্রফুল্লময় । প্রফুল্ল বলিত, “আমার যেমন ভালবাস, উহাদিগকেও তেমনি ভাল ন বাসিলে আমার উপর তোমার ভালবাসা সম্পূর্ণ হইল না । ওরাও আমি " ব্রজেশ্বর তা বুঝিত না । প্রফুল্লের বিষয়বুদ্ধি, বুদ্ধির প্রাখৰ্য্য ও সদ্বিবেচনার গুণে সংসারের বিষয়কৰ্ম্মও তাহার হাতে আসিল তালুক-মুলুকের কাজ বাহিরে হইত বটে, কিন্তু একটু কিছু বিবেচনার কথা উঠিলে, কৰ্ত্ত আসিয়া গিরীকে বলিতেন, “নুতন বউমাকে জিজ্ঞাসা কর দেখি, তিনি কি বলেন ?” প্রফুল্লের পরামর্শে সব কাজ হইতে লাগিল বলিয়া, দিন দিন লক্ষ্মীশ্ৰী বাড়িতে লাগিল শেষ যথাকালে ধন, জন ও সৰ্ব্বমুখে পরিবৃত হইয়। হরবল্লভ পরলোকে গমন করিলেন। বিষয় ব্ৰজেশ্বরের হইল । প্রফুল্লের গুণে ব্রজেশ্বরের নূতন তালুক-মুলুক হইয়। হাতে অনেক নগদ টাক জমিল। তখন প্রফুল্ল বলিল, “আমার সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা কৰ্জ শোধ কর।” ব্র । কেন, তুমি টাকা লইয়া কি করিবে ? প্র । আমি কিছু করিব না, কিন্তু টাকা আমার নয়—শ্ৰীকৃষ্ণের ; কাঙ্গাল-গরিবের ; কাঙ্গাল-গরিবকে দিতে হইবে । ব্র । কি প্রকারে ?