পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আনন্দমঠ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ দীক্ষা-সমাপনাস্তে সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে অতি নিভৃত স্থানে লইয়া গেলেন। উভয়ে উপবেশন করিলে সত্যানন্দ বলিতে লাগিলেন, “দেখ বৎস ! তুমি যে এই মহাব্ৰত গ্রহণ করিলে, ইহাতে ভগবান আমাদের প্রতি অনুকুল বিবেচনা করি । তোমার দ্বারা মা'র মহৎকাৰ্য্য অনুষ্ঠিত হইবে । তুমি যত্নে আমার আদেশ শ্রবণ কর । তোমাকে জীবানন্দভবানন্দের সঙ্গে বনে বনে ফিরিয়া যুদ্ধ করিতে বলি ন । তুমি পদচিহ্নে ফিরিয়া যাও । স্বধামে থাকিয়াই তোমাকে সন্ন্যাসধৰ্ম্ম পালন করিতে হইবে।” মহেন্দ্ৰ শুনিয়া বিস্মিত ও বিমর্ষ হইলেন ; কিছু বলিলেন না। ব্রহ্মচারী বলিতে লাগিলেন, “এক্ষপে আমাদিগের আশ্রয় নাই ; এমন স্থান নাই যে, প্রবল সেনা আসিয়া আমাদিগকে অবরোধ করিলে আমরা খাদ্যসামগ্ৰী লষ্টয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দশ দিন নিৰ্ব্বিঘ্নে থাকিব । আমাদিগের গড় নাই । তোমার আটালিক আছে, তোমার গ্রাম তোমার অধিকারে । আমার ইচ্ছা, সেইখানে একটি গড় প্রস্তুত করি । পরিখা প্রাচারের দ্বারা পদচিহ্ন বেষ্টিত করিয়া মাঝে মাঝে তাহাতে ঘাটি বসাইয়। দিলে, আর বঁাপের উপর কামান বসাইয়া দিলে উত্তম গড় প্রস্তুত হইতে পরিবে। তুমি গৃহে গিয়া বাস কর, ক্রমে ক্রমে দুই হাজার সস্তান সেখানে গিয়া উপস্থিত হইবে । তাহাদিগের দ্বার। গড়, ঘাটির বাধ এই সকল তৈয়ার করিতে থাকিবে । তুমি সেখানে উত্তম লৌহ নিৰ্ম্মিত এক ঘর প্রস্তুত করাইবে, সেখানে সস্তানদিগের অর্থের ভাণ্ডার হইবে । স্ববর্ণে পূর্ণ সিন্দুক সকল তোমার কাছে একে একে প্রেরণ করিব । তুমি সে সকল অর্থের দ্বারা এই সকল কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ করিবে। আর আমি নানা স্থান হইতে কৃতকৰ্ম্ম শিল্পি সকল আনাইতেছি । শিল্পিসকল আসিলে তুমি পদচিহ্নে কারখানা স্থাপন করিবে । সেখানে কামান, গোলা, বারুদ, বন্দুক প্রস্তুত করাইবে । এই জন্য তোমাকে গৃহে যাইতে বলিতেছি ।” মহেন্দ্র স্বীকৃত হইলেন । ‘මාණු সপ্তম পরিচ্ছেদ মহেন্দ্র সত্যানন্দের পাদবনানা করিয়া বিদায় হইলে, তাহার সঙ্গে যে দ্বিতীয় শিষ্য সেই দিন দীক্ষিত হুইয়াছিলেন, তিনি আসিয়া সত্যানন্দকে প্রণাম করিলেন । সত্যানন্দ আশীৰ্ব্বাদ করিয়া কৃষ্ণাজিনের উপর বসিতে অনুমতি করিলেন । পরে অন্তান্ত মিষ্টকথার পর বলিলেন, “কেমন, কৃষ্ণে তোমার গাঢ় ভক্তি আছে কি না ?” শিষ্য বলিল, “কি প্রকারে বলিব ? আমি যাহাকে ভক্তি মনে করি, হয় ত সে ভণ্ডামি, নয় ত আত্মপ্রতারণা ।” সত্যানন্দ সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “ভাল বিবেচনা করিয়াছ, যাহাতে ভক্তি দিন দিন প্রগাঢ় হয়, সেই অনুষ্ঠান করিও । আমি আশীৰ্ব্বাদ করিতেছি, তোমার যত্ন সফল হইবে । কেন না, তুমি বয়সে অতি নবীন ! বৎস, তোমায় কি বলিয়া ডাকিব, তাহ এ পর্য্যস্ত জিজ্ঞাসা করি নাই ।” নুতন সস্তান বলিল, “আপনার যাহা অভিরুচি, আমি বৈষ্ণবের দাসামুদাস ।" সত্য ! তোমার নবীন বয়স দেখিয়া তোমায় নবানানন্দ বলিতে ইচ্ছা করে—অতএব এই নাম তুমি গ্রহণ কর। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার পূৰ্ব্বে কি নাম ছিল ? যদি বলিতে কোন বাধা থাকে, তথাপি বলিও । আমার কাছে বলিলে কর্ণাস্তরে প্রবেশ করিবে না । সস্তানধৰ্ম্মের মৰ্ম্ম এই যে, যাহা অবাচ্য, তাহাও গুরুর নিকট বলিতে হয় ; বলিলে কোন ক্ষতি হয় না । শিষ্য । আমার নাম শাস্তিরাম দেবশৰ্ম্ম । সত্য। তোমার নাম শাস্তিমণি পাপিষ্ঠ । এই বলিয়া সতানন্দ শিষ্যের কাল কুচকুচে দেড় হাত লম্বা দাড়ি বাম হাতে জড়াইয়া ধরিয়া এক টান দিলেন । জাল দাড়ি খসিয়া পড়িল । সত্যাননা বলিলেন, “ছি মা, আমার সঙ্গে প্রতারণা-আর যদি আমাকেই ঠকাবে ত এ বয়সে দেড় হাত দাড়ি কেন ? অার, দাড়ি খাট করিলেও কণ্ঠের স্বর—ও চোখের চাহনি কি লুকাতে পার? যদি এমন নিৰ্ব্বোধই হইতাম, তবে কি এত কাজে হাত দিতাম ?” শাস্তি পোড়ারমুখী তখন দুই চোখ ঢাকা দিয়া কিছুক্ষণ অধোবদনে বসিল । পরক্ষণেই হাত নামাইয়া বুড়োর মুখের উপর বিলোল কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া বুলিল, “প্ৰভু দোই বা কি করিয়াছি ? জীবষ্ণু কি কখন বল থাকে না ?” భాr.