পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫২ কেবল সেই অতি ভয়ানক কামানের ধ্বনি আর দূরশ্ৰত গোরার সমবেত অন্ত্রের ঝনঝনা ও পদধ্বনি । তখন সত্যানন সেই গভীর নিস্তব্ধতামধ্যে অতি উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “জগদীশ হরি তোমাদিগকে কৃপা করিলেন—তোপ কত দূর ?" উপর হইতে এক জন বলিল, “এই কাননের অতি নিকটে একখানা ছোট মাঠ পার মাত্র ।” সত্যানন্দ বলিলেন, “কে তুমি ?” উপর হইতে উত্তর হইল, “আমি নবীনানন্দ।" তখন সত্যানন্দ বলিলেন, “তোমরা দশ সহস্ৰ সন্তান, আজ তোমাদের জয় হইবে, তোপ কাড়িয়া লও ” তখন অগ্রবর্তী অশ্বারোহী জীবানন্দ বলিলেন, “আইস ।” ” সেই দশ সহস্র সস্তান—অশ্ব ও পদাতিক অতিবেগে জীবানন্দের আহ্ববৰ্ত্তী হইল। পদাতির স্বন্ধে বন্দুক, কটিতে তরবারি, হস্তে বল্লম । কানন হইতে নিক্রিান্ত হইবামাত্র সেই অজস্ৰ গোলাবৃষ্টি পড়িয়া তাহাদিগকে ছিন্নভিন্ন করিতে লাগিল । বহুতর . সস্তান বিনা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিয়া ভূমিশায়ী হইল। এক জন জীবানন্দকে বলিল “জীবানন্দ, অনর্থক প্রাণিহত্যায় কাজ কি ?” জীবানন্দ ফিরিয়া চাহিয়া দেখিলেন, ভবানন্দ । জীবানন্দ উত্তর করিলেন, “কি করিতে বল ?” : ভব । বনের ভিতর থাকিয়া বৃক্ষের আশয় হইতে আপনাদিগের প্রাণরক্ষা করি—তোপের মুখে, পরিস্কার মাঠে, বিনা তোপে এ সন্তান সৈন্য এক দণ্ড টিকিবে না ; কিন্তু ঝোপের ভিতর থাকিয় অনেকক্ষণ যুদ্ধ করা যাইতে পারিবে । জীব । তুমি সত্য কথা বলিয়াছ, কিন্তু প্ৰভু আজ্ঞা করিয়াছেন, তোপ কাড়িয়া লইতে হুইবে, অতএব আমরা তোপ কাড়িয়া লইতে বাইব । . . ভব। কার সাধ্য তোপ কাড়ে? কিন্তু যদি " যেতেই হবে, তবে তুমি নিরস্ত হও, আমি যাইতেছি। জীব । তা হবে না—ভবানন্দ । আজ আমার মরিবার দিন । ভব । আজ আমার মরিবার দিন । জীব । আমার প্রায়শ্চিন্তু করিতে হুইবে । ভব। তুমি নিষ্পাপ শরীর—তোমার প্রায়শ্চিত্ত মাই। আমার চিত্ত কলুষিত—আমাকেই মরিতে হুইবে । তুমি থাক, আমি যাই। জীব । ভবানন্দ ! তোমার কি পাপ, আমি জানি না ; কিন্তু তুমি থাকিলে, সস্তানের কার্য্যোদ্ধার হুইবে । আমি যাই। " বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী ভবানন্দ নীরব হইয়া শেষে বলিলেন, “মরিবার প্রয়োজন হয়, আজই মরিব, যে দিন মরিবার প্রয়োজন হইবে, সেই দিনই মরিব, মৃত্যুর পক্ষে আবার কালাকাল কি ?" জীব । তবে এসে । এই কথার পর ভবানন্দ সকলের অগ্রবর্তী হইলেন । তখন দলে দলে ঝণকে বীকে গোলা পড়িয়া সন্তান সৈন্ত খণ্ড-বিখণ্ড করিতেছে, ছিড়িয়া চিরিতেছে, উণ্টাইয়া ফেলিয়া দিতেছে, তাহার উপর শত্রুর বন্দুকওয়াল সিপাহী সৈন্য অব্যর্থ লক্ষ্যে সারি সারি সন্তানদের ভূমে পাড়িয়া ফেলিয়াছে। এমন সময় ভবানন্দ বলিলেন, “এই তরঙ্গে আজ সন্তানকে ঝাপ দিতে হইবে—কে পার ভাই ? এই সময় গাও ‘বন্দে মাতরম্ " তখন উচ্চনিনাদে মেঘমল্লার রাগে সেই সহস্ৰকণ্ঠে সন্তানসেন তোপের তালে গায়িল, “বন্দে মাতরম্ ” দশম পরিচ্ছেদ সেই দশ সহস্ৰ সন্তান ‘বন্দে মাতরম্ গায়িতে গায়িতে বল্লম উন্নত করিয়া, অতি দ্রুতবেগে তোপশ্রেণীর উপর গিয়া পড়িল । গোলাবৃষ্টিতে খণ্ডবিখণ্ড, বিদীর্ণ, উৎপতিত, অভ্যস্ত বিশৃঙ্খল হইয়া গেল, তথাপি সন্তানসৈন্য ফেরে না । সেই সময়ে কাপ্তেম টমাসের আজ্ঞায় এক দল সিপাহী বন্দুকে সঙ্গীন চড়াইয়া প্রবল বেগে সন্তানদিগের দক্ষিণপাশ্বে আক্রমণ করিল : তখন দুই দিক্ হইতে আক্রান্ত হইয়া সস্তানেরা একেবারে নিরাশ হইল। মুহূর্তে শত শত সন্তান বিনষ্ট হইতে লাগিল। তখন জীবানন্দ বলিলেন, “ভবানন, তোমারই কথা ঠিক , আর বৈষ্ণবধ্বংসের প্রয়োজন নাই ; ধীরে ধীরে ফিরি ” * ভব । এখন ফিরিবে কি প্রকারে ? এখন যে পিছন ফিরিবে, সেই মরিবে । জীব । সম্মুখে ও দক্ষিণপার্শ্ব হইতে আক্রমণ হইতেছে । বামপাশ্বে কেহ নাই, চল, অল্পে অল্পে ঘুরিয়া বামদিক দিয়া বেড়িয়া সরিয়া যাই । , ভব। সরিয়া কোথায় যাইবে ? সেখানে যে নদী --নুতন বর্ষায় নদী যে অতি প্রবল হইয়াছে। তুমি ইংরেজের গোলা হইতে পলাইয়। এই সস্তানসেন নদীর জলে ডুবাইবে ? g জীব । নদীর উপর একটা পুল আছে, আমার স্মরণ হইতেছে।