পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মিশামিশি ঠেসাঠেসি ছুইয়া পড়িয় রছিয়াছে। সেই , মাঘমাসের পূর্ণিমার রীজ দারুণ শীতে উজ্জল জ্যোৎস্না&লোকে রণভূমি অতি ভয়ঙ্কর দেখাইতেছিল। সেখানে མ་ ༥་། কাহারও সাহস হয় না । কাহারও সাহস হয় না, কিন্তু নিশীথকালে এক রমণী সেই অগম্য রণক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছিল। একটি মশাল জালিয়া সেই শবরাশির মধ্যে সে কি খুজিতেছিল। ‘ প্রত্যেক মৃতদেহের মুখের কাছে মশাল লইয়া মুখ দেখিয়া, আবার অন্য শবের কাছে মশাল লইয়া যাইতেছিল । কোথায় কোন নরদেহ মৃত অশ্বের নীচে পড়িয়াছে, সেখানে যুবতী মশাল মাটীতে রাখিয়া অশ্বটি দুই হাতে সরাইয়া নরদেহ উদ্ধার করিতেছিল। তার পর যখন দেখিতে পায়, সে যাকে খুজিতেছে, সে নয়, তখন মশাল তুলিয়া সরিয়া যায়। এইরূপ অনুসন্ধান করিয়া যুবতী সকল মাঠ ফিরিল—য খুঁজে, ত৷ কোথাও পাইল না । তখন মশাল ফেলিয়৷ সেই শবরাশিপূর্ণ রুধিরাক্ত ভূমিতে লুটাইয় পড়িয়া কাদিতে লাগিল । সে শাস্তি, জীবানন্দের দেহ খুজিতেছিল। শাস্তি লুটাইয়া পড়িয়া কাদিতে লাগিল, এমন সময়ে এক অতি মধুর সকরুণ ধ্বনি তাহার কর্ণরন্ধে প্রবেশ করিল। কে যেন বলিতেছে, “উঠ মা ! কঁাদিও ন৷ ” শান্তি চাহিয়া দেখিল—দেখিল, সম্মুখে জ্যোৎস্নালোকে দাড়াইয়া এক অপূৰ্ব্বদৃশু প্রকাণ্ডাকার জটাজুটধারী মহাপুরুষ । শান্তি উঠিয়া দাড়াইল । যিনি আসিয়াছিলেন, তিনি বলিলেন, “র্কাদিও না মা ! জীবানন্দের দেহ আমি খুজিয়া দিতেছি, তুমি আমার সঙ্গে আইস !” তখন সেই পুরুষ শাস্তিকে রণক্ষেত্রের মধ্যস্থলে লইয়া গেলেন ; সেখানে অসংখ্য শবরাশি উপযু পরি পড়িয়াছে । শাস্তি তাহা সকল নাড়িতে পারে নাই। সেই শবরাশি নাড়িয়া সেই মহা বলবান পুরুষ এক মৃতদেহ বাহির করিলেন । শাস্তি চিনিল, সেই জীবানদের দেহ । সৰ্ব্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত রুধিরে পরিপ্লুত। শান্তি সামান্ত স্ত্রীলোকের ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে কাদিতে লাগিল । - আবার তিনি বলিলেন, “র্কাদিও না মা ! জীবানন্দ কি মরিয়াছে ? স্থির হইয়া ইহার দেহ পরীক্ষা করিয়া দেখ ! আগে নাড়ী দেখ ।” শান্তি শবের নাড়ী টিপিয়া দেখিল, কিছুমাত্র গতি নাই। সেই পুরুষ বলিলন, “বুকে হাত দিয়া দেখ।” যেখানে হৃৎপিণ্ড, শাস্তি সেইখানে হাত দিয়া দেখিল, কিছুমাত্র গতি নাই, সব শীতল । বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী । সেই পুরুষ আবার বলিলেন, নীকের কাছে হাত দিয়া দেখ–কিছুমাত্র নিশ্বাস বহিতেছে কি ?” শাস্তি দেখিল, কিছুমাত্র না । - সেই পুরুষ বলিলেন, “আবার দেখ, মুখের ভিতর আঙ্গুল দিয়া দেখ–কিছুমাত্র উষ্ণতা আছে কি না ?” শাস্তি অঙ্গুলি দিয়া দেখিয়া বলিল, “বুঝিতে পারিতেছি না ।” শান্তি আশামুগ্ধ হইয়াছিল। মহাপুরুষ বাম হস্তে জীবানদের দেহ স্পর্শ করিলেন । বলিলেন, “তুমি ভয়ে হতাশ হইয়াছ। তাই বুঝিতে পারিতেছ না—শরীরে কিছু তাপ এখনও আছে বোধ হইতেছে । আবার দেখ দেখি ” শান্তি তখন আবার নাড়ী দেখিল, কিছু গতি আছে । বিস্মিত হইয়। হৃৎপিণ্ডের উপর হাত রাখিল —একটু ধৰ্ব্ব ধক্ করিতেছে। নাকের আগে অঙ্গুলি রাখিল—একটু নিশ্বাস বহিতেছে। মুখের ভিতর অল্প উষ্ণতা পাওয়া গেল ! শান্তি বিস্মিত হইয়া বলিল, “প্রাণ ছিল কি ? ন! আবার আসিয়াছে ?” তিনি বলিলেন, “তাও কি হয় মা ! তুমি উহাকে বহিয়া পুষ্করিণীতে আনিতে পারিবে ? আমি চিকিৎ সক, উহার চিকিৎসা করিব।” শাস্তি অনায়াসে জীবানন্দকে কোলে তুলিয়। পুকুরের দিকে লইয়া চলিল। চিকিৎসক বলিলেন, “তুমি ইহাকে পুকুরে লইয়া গিয়া রক্ত সকল ধুইয়া দাও । আমি ঔষধ লইয়। যাইতেছি ।” শান্তি জীবানন্কে পুষ্করিণীতীরে লইয়া গিয়া রক্ত, ধৌত করিল । তখনই চিকিৎসক বন্ত লতাপাতার প্রলেপ লইয়া আসিয়া সকল ক্ষতমুখে দিলেন, তার পর বারংবার জীবানন্দের সৰ্ব্বাঙ্গে হাত বুলাইলেন। তখন জীবানন্দ এক দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া উঠিয়া বসিলেন । শাস্তির মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “যুদ্ধে কার জয় হইল ?” শাস্তি বলিল, “তোমারই জয় । এই মহাত্মাকে প্রণাম কর ।” তখন উভয়ে দেখিল, কেহ কোথাও নাই । কাহাকে প্রণাম করিবে ? - নিকটে বিজয়ী সন্তানসেনার বিষম কোলাহল শুনা যাইতেছিল, কিন্তু শাস্তি বা জীবানন্দ কেহই উঠিল না—সেই পূর্ণচন্দ্রের কিরণে সমুজ্জ্বল পুষ্করিণীসোপানে বসিয়া রহিল । জীবানন্দের শরীর ঔষধের গুণে অতি অল্পসময়েই সুস্থ হইয়া আসিল । তিনি বলিলেন, “শাস্তি ! সেই চিকিৎসকের ঔষধের আশ্চৰ্য্য গুণ ! আমার শরীরে আর কোন বেদন বা গ্লানি