পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উপক্রমণিক। প্রথম পরিচ্ছেদ বালক-বালিক। ভাগীরথীতীরে আমুকাননে বসির একটি বালক ভাগীরথীর সান্ধ্য জলকল্লোল শ্রবণ করিতেছিল । তাহার পদতলে নবদুৰ্ব্বাশয্যায় শয়ন করিয়া একটি ক্ষুদ্র বালিকা নীরবে তাহার মুখ পানে চাহিয়৷ ছিল - চাহিয়া, চাহিয়া, চাহিয়, আকাশ, নদী, বৃক্ষ দেখিয়, আবার সেই মুখপানে চাহিয়৷ রহিল । বালকের নাম প্রতাপ—বালিকার নাম শৈবলিনা । শৈবলিনা তখন সাত আট বৎসরের বালিক! —প্ৰতাপ কিশোরবয়স্ক । - মাথার উপরে, শণ তরঙ্গে আকাশমণ্ডল ভাসাইয়। পাপিয়া ডাকিয় গেল । শৈবলিনী, তাহার অন্তকরণ করিয়া, গঙ্গাকুল-বিরাজী আম্রকানন কম্পিত করিতে লাগিল । গঙ্গার তর ভর রব সে ব্যঙ্গ-সঙ্গীত সঙ্গে মিলাইয়া গেল । বালিক! ক্ষুদ্র করপল্লবে, ভদ্ধং সুকুমার ব্যকুসুম চয়ন করিয়৷ মাল৷ গাথিয়|, বালকের গলায় পরাইল । আবার খুলিয়া লইয়। আপন কবরীতে পরাইল, আবার পুলিয়। বালকের গলায় পরাইল । স্থির হুইল না—কে মাল পরিবে : নিকটে হৃষ্ট পুষ্ট একটি গাই চরিতেছে দেখিয়। শৈবলিনা বিবাদের মাল। তাহার শুঙ্গে পরাইয়। আসিল-; তখন বিবাদ মিটিল । এইরূপ ইহাদের সর্বদ হইত । কখন বা মালার বিনিময়ে বালক, নীড় হষ্টতে পক্ষিশাবক পড়িয়! দিত, আমের সময় সুপক্ক আয় পাড়িয়া দিত । সন্ধ্যার কোমল আকাশে তারা উঠিলে, উভয়ে তারা গণিতে বসিল । কে আগে দেখিয়াছে ? কোনটি আগে উঠিয়াছে ? তুমি কয়ট দেখিতে পাইতেছ ? চারিটা ? আমি পাচটা দেখিতেছি । ঐ একটা, ঐ একট, ঐ একটা, ঐ একটা, ঐ একটা । মিথ্যা কথা । শৈবলিনী তিনটা বৈ দেখিতেছে না । 曦 নৌকা গণ । কয়খানা নৌক। যাইতেছে, বল দেখি ? ষোলখান ? বাজি রাখ, আঠারখানা । শৈবলিনী গণিতে জানিত না , একবার গণিয়া নয়খান হইল, আর একবার গণিয়া একুশখান হইল । তার পর গণনা ছাড়িয়া, উভয়ে একাগ্রচিত্তে একখানি নৌকার প্রতি দৃষ্টি স্থির করিয়া রাখিল । নৌকায় কে আছে-কোথ। যাইবে—কোথা হইতে আসিল ? দাড়ের জলে কেমন সোণ জ্বলিতেছে । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ডুবিল বা কে, উঠিল বা কে এইরূপে ভালবাসা জন্মিল । প্রণয় বলিতে হয় বল, ন বলিতে তর, না বল । ষোল বৎসরের নায়ক -- আট বৎসরের নায়িক| বালকের ন্যায় কেহ ভালবাসিতে জানে না । বালীকালের ভালবাসাদ বুঝি কিছু অভিসম্পাত আছে । যাহাঁদের বাল্যকালে ভালবাসিয়াছ, তাহাদের কয় জনের সঙ্গে যৌবনে দেখা-সাক্ষাৎ হয় ? কয় জন বঁাচিয়! থাকে ? কয় জন ভালবাসার যোগ্য থাকে ? বাৰ্দ্ধকে বালiপ্রণয়ের স্মৃতিমাত্র থাকে, আর সকল বিলুপ্ত হয় । কিন্তু সেই স্মৃতি কত মধুর ! বালকমাত্রেই কোন সময়ে না কোন সময়ে অল্পম্ভুত করিয়াছে যে, ঐ বালিকার মুখমণ্ডল অতি মধুর—উহার চক্ষে কোন বোধ্যতীত গুণ আছে । খেল। ছাড়িয়। কতবার তাহর মুখপানে চাহিয়া দেখিয়াছে –৩হার পথের ধারে, অন্তরালে দাড়াইয়া কতবার তাহাকে দেখিয়াছে । কখন বুঝিতে পারে নাই, অথচ ভালবাসিয়াছে। তাহার পর সেই মধুর মুখ—সেই সরল কটাক্ষ—কোথায় কালপ্রবাহে ভাসিয়া গিয়াছে। তাহার জন্য পৃথিবী খুজিয়া দেখি - কেবল স্থতিমাত্র আছে । বাল্য-প্রণয়ে কোন অভিসম্পাত আছে । শৈবলিনী মনে মনে জানিত, প্রতাপের সঙ্গে আমার বিবাহ হইবে । প্রতাপ জানিত, বিবাহ হুইবে না । শৈবলিনী প্রতাপের জ্ঞাতি-কন্যা । সম্বন্ধ দুর বটে, কিন্তু জ্ঞাতি ৷ শৈবলিনীর এই প্রথম হিসাবে ভুল । শৈবলিনী দরিদ্রের কন্য। কেহ ছিল না, কেবল মাতা । তাহাদের কিছু ছিল না, কেবল একখানি কুটীর—আর শৈবলিনীর রূপরাশি । প্রতাপও দরিদ্র ।