পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সীতারাম রম । তা ত করবে, কিন্তু যদি না পারলে ? গঙ্গা । না পারি, মরিব । রম । তা করিও না । আমার কথা শোন । আজ সকলে বড়রাণীকে বলিতেছে, মুসলমানকে আদর করিয়া ডাকিয়া, সহর তাদের সঁপিয়া দাও--আপনদের সকলের প্রাণভিক্ষ মাগিয়! লও । বড়রাণী সে কথায় বড় কান দিলেন না--তার বুদ্ধিশুদ্ধি বড় ভাল নয়। আমি তাই তোমায় ডাকিয়াছি । তা কিছু হয় না ? গঙ্গা । আমাকে কি করিতে বলেন ? রমা। এই আমার গহনা-পাতি আছে সব নাও । আর আমার টাকা-কড়ি যা আছে, সব না হয় দিতেছি, সব নাও । তুমি কাহাকে কিছু না বলিয়। মুসলমানের কাছে যাঁও । বল গিয়া যে, আমরা রাজ্য ছাড়িয়া দিতেছি, তোমরা কাহাকে প্রাণে মারিবে না, কেবল এইটি স্বীকার কর । যদি তাহার। রাজি হুয়, তবে নগর তোমার হাতে--তুমি তাদের গোপনে এনে কেল্লায় তাদের দখল দিও। সকলে বাচিয়া বাইবে । গঙ্গারাম শিহরিয়া উঠিল—বলিল, “মহারাণি ! আমার সাক্ষাতে যা বল্লেন বল্লেন--তার কখন কাহারও সাক্ষাতে এমন কথা মূখে আনিবেন না । আমি প্রাণে মরিলেও এ কাজ আমি হইতে হইবে না । যদি এমন কাজ আর কেহু করে, আমি স্বহস্তে তাহার মাথ। কাটিয়া ফেলিব ।” রমার শেষ আশা-ভরসা ফর্স হইল । রম। উচ্চৈঃস্বরে কাদিয়া উঠিল । বলিল, “তবে আমার বাছার দশা কি হইবে ?” গঙ্গাপ্লাম ভীত হইয়। বলিল, “চুপ করুন। যদি আপনার কান্না শুনিয়া কেহ এখানে আসে, তবে আমাদের দুই জনেরই পক্ষে অমঙ্গল । আপনার ছেলের জন্যই আপনি এত ভীত হইয়াছেন, আমি সে বিষয়ে "কোন উপায় করিব । আপনি স্থানান্তরে যাইতে রাজি আছেন ?” রম । যদি আমার বাপের বাড়ী রাখিয়৷ আসিতে পার, তবে যাইতে পারি। তা বড় রাণীই বা যাইতে দিবেন কেন ? ঠাকুর মহাশয় ব৷ যাইতে দিবেন কেন ? গঙ্গা । তবে লুকাইয়া লইয়া যাইতে হইবে । এক্ষণে তাহার কোন প্রয়োজন নাই । যদি তেমন বিপদ দেখি, আমি আসিয়া আপনাকে লইয়া গিয়া রাখিয়া আসিব । Rషి রম । আমি কি প্রকারে সংবাদ পাইব ? গঙ্গা । মুরলার দ্বার সংবাদ লইবেন । কিন্তু মুরলা যেন অতি গোপনে আমার কাছে যায়। রম নিশ্বাস ছাড়িয়া কাদিয়া বলিল, “তুমি আমার প্রাণদান করিলে, আমি চিরদিন তোমার দাসী হইয়া থাকিব । দেবতার তোমার মঙ্গল করুন।” এই বলিয়া রমা গঙ্গারামকে বিদায় দিল । মুরলা গঙ্গারামকে বাহিরে রাখিয়া আসিল । - কাহারও মনে কোন মল! নাই । তথাপি একটা গুরুতর দোষের কাজ হইয় গেল । রম ও গঙ্গা রাম উভয়ে তাহ মনে বুঝিল । গঙ্গারাম ভাবিল, “আমার দোষ কি ?”—রম বলিল, “এ না করিয়া কি করি—প্রাণ যায় যে " কেবল মুরলা সস্তুষ্ট । গঙ্গরামের যদি তেমন চক্ষু থাকিত, তবে গঙ্গারাম ইহার ভিতর আর এক জন লুকাইয়া আছে, দেখিতে পাইতেন । সে মানুষ নহে—দেখিতেন—

  • “দক্ষিণপাঙ্গনিবিষ্টমুষ্টিং নতাংসমাকুঞ্চিতসব্যপাদম্।
  • * * চক্রীকৃতচারুচাপং প্রহর্ভু,মভু্যদ্যতমাত্মযোনিম্ ॥” এ দিকে বাদীর মনেও যা, বিধির মনেও তা । চন্দ্রচূড় ঠাকুর তোরাব, খার কাছে এই কথা বলিয়া গুপ্তচর পাঠাইলেন যে, “আমরা এ রাজ্য মায় কেল্লা, শেলেখান। আপনাদিগকে বিক্রয় করিব—কত টাকা দিবেন ? যুদ্ধে কাজ কি ?—টাক দিয়া নিন না ?”

চন্দ্রচূড় মৃন্ময়কে ও গঙ্গারামকে এ কথা জানাইলেন। মৃন্ময় ক্রুদ্ধ হইয়া চক্ষু ঘুরাইয়া বলিল, “কি ! এত বড় কথা ?” চন্দ্রচূড় বলিলেন, “দুর মূৰ্খ! কিছু বুদ্ধি নাই কি ? দরদস্তুর করিতে করিতে এখন দুই মাস কাটাইতে পারিব । তত দিনে রাজা আসিয়া পড়িবেন ।” গঙ্গারামের মনে কি হইল, বলিতে পারি না । সে কিছুই বলিল না । ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ তা, সে দিন গঙ্গারামের কোন কাজ করা হইল ন। রমার মুখখানি বড় সুন্দর, কি সুন্দর আলোই তার উপর পড়িয়াছিল। সেই কথা ভাবিতেই গঙ্গারামের দিন গেল ! বাতির আলো বলিয়াই কি আমন দেখাইল ? তা হ’লে মানুষ রাত্রিদিন আলো জালিয়া বসিয়া থাকে না