পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তৃতীয় খণ্ড ভ্রাত্ৰি—ভশক্রিনী প্রথম পরিচ্ছেদ ভূষণ দখল হইল। যুদ্ধে সীতারামের জয় হইল । তোরাব, খ মৃন্ময়ের হাতে মারা পড়িলেন । সে সকল ঐতিহাসিক কথ। । কাজেই তামাদের কাছে ছোট কথা । আমরা তাহার বিস্তারিত বর্ণনায় কালক্ষেপ করিতে পারি না । উপন্যাসলেখক অস্তৰ্ব্বিষয়েব প্রকটনে যত্নবান হইবেন, ইতিবৃত্তের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখা লিম্প্রয়োজন । ভূমণ অধিকৃত হইল । বাদশাহী সনদের বলে এবং নিজ বাহুবলে সাতারাম বাঙ্গালার দ্বাদশ ভৌমিকের উপর আধিপত্য স্থাপন করিয়! মহারাজ উপাধি গ্রহণপূৰ্ব্বক প্রচণ্ড প্রভাপে শাসন আরম্ভ করিলেন । শাসন সম্বন্ধে আগেষ্ট গঙ্গারামের দণ্ডের কথাটা উঠিল । তাতার বিরুদ্ধে প্রমাণের অভাব ছিল না । পতি-প্রণ। অপরাধিনী রমাই সমস্ত বৃত্তস্ত অকপটে সাতারামের নিকট প্রকাশ করিল । বাকি যেটুকু, মুরলা ও চাদশাহ ফকীর সকলই প্রকাশ করিল। কেবল গঙ্গারামকে জিজ্ঞাসা কর; বাকি—এমন সময়ে এ কথা লইয়া গোলযোগ উপস্থিত হইল । কথাগুলা রম আন্তঃপুরে বসিয়া সীতারামের কাছে, চক্ষুর জলে ভাসিতে ভাসিতে বলিল সীতী রাম তাহার এক বর্ণ অবিশ্বাস করিলেন ন! ৷ বুঝিলেন, সরলা রম নিরপরাধিনী, অপরাধের মধ্যে কেবল পুত্রস্নেহ । কিন্তু সাধারণ পুরবাসী লোক তাহা ভাবিল ন। । গঙ্গারাম কয়েদ হইল কেন ? এই কথাটা লইয়া সহরে বড় আন্দোলন পড়িয় গেল। কতক মুরলার দোলে, কতক সেই পাহারাওয়াল পড়ে ঠাকুরের গল্পের জাকে, রমার নামটা সেই সঙ্গে লোকে মিলাইতে লাগিল । কেহ বলিল যে, গঙ্গারাম মোগলকে রাজ্য বেচিতে বসিয়াছিল । কেহ বলিল যে, সে ছোটরাণীর মহলে গিরেপ্তার হইয়াছিল, কেহ বলিল, দুই কথাই সত্য, আর রাজ্য বেচার পরামর্শে ছোটরাণীও ছিলেন । রাজার কানে এত কথা উঠে না, কিন্তু রাণীর কাণে উঠে—মেয়েমহলে এ রকম কথ|গুল সহজে প্রচার পায়-শাখা-প্রশাখ সমেত । দুই রাণীর কানেই কথা উঠিল । রমা শুনিয়া শষ। ২য়—২৬ লইল, র্কাদিয়া বালিস ভাসাইল, শেষ গলায় দড়ি দিয়া কি জলে ডুবিয়া মরা ঠিক করিল । নন্দ শুনিয়া বুদ্ধিমতীর মত কাজ করিল। নন্দ খুজিয়া খুজিয়া, রম যেখানে বালিসে মুখ ঝণপিয়া কাদিতেছে, আর পুকুরে ডুবিয়। মরা সোজা, কি গলায় দড়ি দিয়া মরা সোজ, ইহার যতদূর সাধ্য মীমাংস করিতেছে, সেইখানে গিয়া, তাহাকে ধরিল ৷ বলিল, “দেখিতেছি, তুমিও ছাই কথা শুনিয়াছ ।” রম। কেবল ঘাড় নাড়িল—অর্থাৎ “শুনিয়াছি।” চক্ষুর জল বড় বেশী ছুটিল । নন্দ তাহার চক্ষুর জল মুছাইয়া সম্বেহুবচনে বলিল, “কাদিলে কলঙ্ক যাবে না, দিদি ! ন! কাদিয়া, যাতে এ কলঙ্ক মুছিয়। তুলিতে পারি, তাই করিতে হুইবে । পারিস ত উঠিয়। বসিয়! ধীরে মুস্থে আমাকে সকল কথ। ভাঙ্গিয় চুরিয়া বল্ দেখি, এখন আমাকে সতীন ভাবিস না কালি চূণ তোর গালে পড়ুক ন পডুক, রাজারই বড় মাথ! হেঁট হয়েছে । তিনি তোরও প্রভু --আমারও প্রভু ; এ লজ্জা আমার চেয়ে তোর যে বেশী, তা মনে করিস ন! । আর মহারাজ আমাকে অন্তঃপুরের ভার দিয়া গিয়াছেন, তার কানে এ কথ। উঠিলে আমি কি জবাব দিব ?” রম! বলিল, “যাহা যাহ হইয়াছিল, আমি তাহাকে বলিয়াছি, তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া আমাকে ক্ষমা করিয়াছেন । আমার ত কোন দোষ নাষ্ট יין নন্দ । তা বলিতে হইবে না—তোর ষে কোন দোষ নাই, সে কথা আমায় বলিয়। কেন দুঃখ পাস ? তবে কি হইয়াছিল, তা আমাকে বলিস না বলিস্— রম । বলিব না কেন ? আমি এ কথা সকলকেই বলিতে পারি। এই বলিয়। রমা চক্ষুজল সাম্‌লাইয়া, উঠিয়া বসিয়া, সকল কথা যথার্থরূপে নন্দাকে বলিল । নন্দার সে কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস জন্মিল । নন্দ বলিল, “যদি ঘুণাক্ষরে আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া এ কাজ করিতে দিদি, তবে কি এত কাণ্ড হইতে পায় ? তা ষাকৃ, যা হয়ে গিয়েছে, তার জন্য তিরস্কার করিয়া এখন আর কি হইবে ? এখন যাহাতে আবার মানসন্ত্রম বজায় হয়, তাই করিতে হইবে।”