পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সীতারাম গুনিয়া গঙ্গারাম বলিল, “মহারাজ । ইহ সম্ভব নহে । মুরলার ভাইকেই বা ঐ ব্যক্তি পথ ছাড়িয়৷ দিবে কেন ?” তথম পাড়ে -ঠাকুর উত্তর করিলেন যে, “তিনি গঙ্গারামকে বিলক্ষণ চিনিতেন ; তবে কোতোয়ালকে তিনি রোখেন কি প্রকারে ? এ জন্য চিনিয়াও চিনিতেন না ।" গঙ্গারাম দেখিল, ক্রমে গতিক মন্দ হইয়া আসিল । এক ভরস মনে এই উদয় হইল, মুরল। নিজে কখনও এ সকল কথ। প্রকাশ করিবে না-কেন ন!, তাহ হইলে সে-ও দণ্ডনীয়—তার কি আপনার প্রাণের ভয় নাই ? তখন গঙ্গারাম বলিল, “মুরলাকে ডাকিয় জিজ্ঞাস করা হউক, কথা সকলই মিথ্য প্রকাশ পাইবে ।" বেচারা জনিত ন যে, মুরলাকে মহারাজ্ঞী খ্ৰীমতী নন্দ ঠাকুরাণী পূৰ্ব্বেষ্ট তা ত করিয়া রাখিয়াছিলেন । নন্দ মুরলাকে বুঝাইয়াছিলেন সে, “মহারাজ স্ত্রী-হত্য করেন না, তোর মরিবার ভয় নাই । স্ত্রীলোককে শারীরিক কোন রকম সাজা দেন না । অতএব বড় সাজার তোর ভয় নাই । কিছু সাঙ্গ তোর হইবেই হুইবে । তবে তুষ্ট ঘদি সত্যকথা বলিস—তোর সাজ। বড় কম হইবে ।" মুরলা ও গ্ৰহ বুঝিয়াছিল, সুতরাং সব কথ। ঠিক বলল, কিছুই ছাড়িল না । মুরলার কথ। গঙ্গারামের মাথায় বজ্রাঘাতের মত পড়িল । তথাপি সে আশা চড়িল ন! ! বলিল, “মহারাজ ! এ স্ত্রীলোক অতি কুচরিত্র । আমি নগরমধ্যে ইহাকে অনেকবার ধরিয়াছি এবং কিছু শাসনও করিতে হইয়াছিল । বোধ হয়, সেই রাগে এ সকল কথা বলিতেছে ।” রাজা । তবে কার কথায় বিশ্বাস করিব, গঙ্গারাম ? খোদ মহারাণীর কথ। বিশ্বাসযোগ্য কি ? গঙ্গারাম যেন হাত বাড়াইয়। স্বর্গ পাইল । তাহার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, রমা কখন এ সভার মধ্যে আসিবে ন, বা এ সভায় এ সকল কথ। বলিতে পরিবে না । গঙ্গারাম বলিল, “অবশু বিশ্বাসযোগ্য । তার কথায় যদি আমি দোষী হই, আমাকে সমুচিত দণ্ড দিবেন।” রাজা অন্তঃপুর অভিমুখে দৃষ্টি করিলেন । তখন গঙ্গারাম সবিস্ময়ে দেখিল, অতি ধীরে ধীরে শঙ্কিত শিশুর মত, এক মলিনবেশধারিণী অবগুণ্ঠনবতী রমণী সভামধ্যে আসিতেছে । যে রূপ গঙ্গারামের হাড়ে হাড়ে আঁকা, তাহ দেখিয়াই চিনিল । গঙ্গারাম বড় শঙ্কিত হইল । দর্শকমণ্ডলীমধ্যে মহা কোলাহল পড়িয়া গেল । শান্তিরক্ষকেরা তাহাদের থামাইল । 8 রম আসিয়া আগে রাজাকে, পরে গুরু চন্দ্রচুড়কে । দূর হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া, অবগুণ্ঠন ৷ মোচন করিয়া সৰ্ব্বসমক্ষে দাড়াইল—মলিন-বেশেও । রূপরাশি উছলিম পড়িতে লাগিল। চন্দ্রচূড় দেখি, লেন, রাজা কথা কহিতে পারিতেছেন না—অধোবদনে এই গঙ্গারামের বিচার হইতেছে । এ আপনার অন্তঃপুরে গিয়াছিল কি না, গিয়া থাকে, তবে jo 3. আছেন । তখন চন্দ্রচূড় রমাকে বলিলেন, “মহারাণি । ’ ব্যক্তি কথন । কেন গিয়াছিল, আপনার সঙ্গে কি কি কথা হইয়াছিল, , সব স্বরূপ বলুন । রাজার তাজ্ঞা, আর আমি তোমার গুরু, আমার আজ্ঞা, সকল কথা সত্য বলিবে ।” প্রম গ্রীব। উন্নত করিয়া গুরুকে বলিল, “রাজার রাণীতে কখনও মিথ্য বলে না । আমরা যদি মিথ্যাবাদিনী হইতাম, তবে এই সিংহাসন এত দিন ভাঙ্গিয়৷ গুড়া হইয়! যাইত ” দর্শকমণ্ডলী বাহির হইতে জয়ধ্বনি দিল—“জয়' মহারাণীজিকী জয় ।” রম সাহস পাষ্টয়া বলিতে লাগিল, “বলিব কি গুরুদেব, আমি রাজার মহিী— রাজার ভূত্য আমার তৃতা—আমি সে আজ্ঞা করিব—রাজার ভৃত্য তা কেন পালন করিবে না ? আমি রাজকর্য্যের জন্য কোতোয়ালকে ডাকিয় পাঠ{ষ্টয়ছিলাম—কোতোস্নাল আসিয়| আজ্ঞা শুনিয়া গিয়াছিল—তার আর বিচারক্ট বা কেন, আমি বলিবই ব! কি ?” কথা শুনিয়া দশকমণ্ডলী এবার আর জয়ধ্বনি করিল না—অনেকে বিষঃ হইল—অনেকে বলিল— “কবুল ।" চন্দ্রচূড় বলিলেন, “এমন কি রাজকাৰ্য্য মা ! যে রাত্রিতে কোতোয়ালকে ডাকিতে হয় ?” রম। তখন বলিল, “তবে সকল কথা শুকুন।” এই বলিয়া রম! দেখিল, পুল্ল কোথ৷ ? পুত্র সুসজ্জিত হইয়া ধাত্ৰীক্রোড়ে । মুখ দেখিয়া সাহস পাইল । তখন রম সবিশেষ বলিতে আরম্ভ করিলেন । প্রথমে অতি ধীরে ধীরে, অতি দূরাগত সঙ্গীতের মত, রমা বলিতে লাগিল—সকলে শুনিতে পাইল না । বাহিরের দর্শকমণ্ডলী বলিতে লাগিল, “মা ! আমরা শুনিতে পাইতেছি না-—আমরা শুনিব ।" রমা আরও একটু স্পষ্ট বলিতে লাগিল । ক্রমে আরও স্পষ্ট— আরও স্পষ্ট । তার পর যখন রমা পুত্রের বিপৎশঙ্কায় এই সাহসের কাজ করিয়াছিল, এই কথা বুঝাইতে লাগিল—ষখন একবার একবার সেই চাদমুখ দেখিতে লাগিল, আর অশ্রপরিপ্লুত হইয়া মাতৃস্নেহের উচ্ছ্বাসের উপর উচ্ছ্বাস, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ