পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সীতারাম নাই। গঙ্গারাম বুদ্ধিমান, বুঝিয়াছিল যে, প্রজাবৰ্গ যেমন নিম্পত্তি করিবে, রাজাও সেইমত করিবেন। তখন সে রাজাকে সম্বোধন করিয়৷ লোকের মনভুলনি কথা বলিতে আরম্ভ করিল ;– “মহারাজ ! কথাট। এই যে, স্ত্রীলোকের কথায় বিশ্বাস করিবেন—ন| আমার কথায় বিশ্বাস করিবেন ? প্রভু ! আপনার এই রাজ্য কি স্ত্রীলোকে সস্থাপিত করিয়াছে - ন! আমার দ্যায় রাজভৃত্যদিগের বাহুবলে স্তাপিত হইয়াছে ? মহারাজ ! সকল স্ত্রীলোকেই বিপথগামিনী হঠতে পারে, রাজরাণীরাও বিপথগামিনী হইয়। থাকেন ; রজরাণী বিপথগামিনী হঠলে রাজার কৰ্ত্তব্য সে, তাঁহাকে পরিত্যাগ করেন । বিশ্বাসী ভূত কথন ও বিপথগামী হয় ন! ; তবে স্বালাকে আপনার দোযক্ষালন জষ্ঠ ভূত্যের ঘাড়ে চাপ দিতে পারে । এই মহরিাণী রাত্রিতে কাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়! আমাকে দাধা করিতেছেন, তাহার স্থিরতা-মহারাজ, রক্ষা কর । রক্ষ। কর ।” কথ! কহিতে কহিতে গঙ্গারাম কথ। সমাপ্ত ন! করিয়া, --আতিশয় ‘ভাত হুষ্টয়, “মহারাজ, রক্ষা কর । রক্ষা কর," এই শব্দ করিয়! স্তম্ভিত বিহুবলের মত দাড়াইয়া রহিল । সকলে দেখিল, গঙ্গারাম থর থর কাপিতেছে । তখন সমস্ত জলমণ্ডলা সবিস্ময়ে সভয়ে ঢাহিয়৷ দেখিল-অপূৰ্ব্বমূৰ্ত্তি, জটাজুটবিলম্বিনী, গৈরিক ধারিণী, জ্যোতিৰ্ম্মল্লা মূৰ্ত্ত, সাক্ষাৎ সিংহবাহিনী দুৰ্গাতুল্য, ত্রিশূল হস্তে গঙ্গারামকে ত্রিশূলাগ্রভাগে লক্ষ্য করিয়া, প্রখরগমনে তাহার অভিমুখে সভামণ্ডপ পার হইয়! আসিতেছে । দেখিবামাত্র সেই সাগরবং সংক্ষুব্ধ জনমণ্ডলা একেবারে নিস্তব্ধ হইল । গঙ্গারাম এক দিন রাবিতে সে মূৰ্ত্ত দেখিয়াছিল - আবার এই বিপতকালে, যখন মিথ্য প্রবঞ্চনার দ্বারা নিরপরাধিনী রমার সৰ্ব্বনাশ করিতে সে উদ্যত, সেই সময়ে সেই মূৰ্ত্তি দেখিয়া, চণ্ডা তাহাকে বধ করিতে আসিতেছেন বিবেচনা করিয়ুi, ভয়ে কাতর হইয়। "রক্ষা কর, রক্ষা কর !" শব্দ করিয়| উঠিল । এ দিকে রাজ, ও দিকে চন্দ্রচুড়, সেই রাত্রিদৃষ্ট দেবতুল্য মূৰ্ত্তি দেখিয়া চিনিলেন এবং নগরের রাজলক্ষ্মী মনে করিয়া সসন্ত্রমে গাত্ৰোখান করিলেন । তখনই সভাস্থ সকলেই গাত্ৰোখান করিল। জয়ন্তী কোন দিকে দৃষ্টি না করিয়া, খরপদে গঙ্গারামের নিকট আসিয়া গঙ্গারামের বক্ষে সেই মন্ত্রপূত ত্রিশূলাগ্রভাগ স্থাপন করিল। কথার মধ্যে কেবল বলিল, “এখন বল ।" 8సి ত্ৰিশূল গঙ্গারামের গাত্র স্পর্শ করিল মার, তথাপি গঙ্গারামের শরীর হঠাৎ অবসন্ন হষ্টয়া আসিল, গঙ্গারাম মনে করিল, তার একটি মিথ্যাকথা বলিলেই এই ত্ৰিশূল আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হইবে । গঙ্গারাম তখন সভয়ে বিনীতভাবে সত। বৃত্তান্ত সভা-সমক্ষে বলিতে আরম্ভ করিল। যতক্ষণ ন! তাহার কথা সমাপ্ত হইল, ততক্ষণ জয়ন্তী তাহাৰ হৃদয় ত্ৰিশলাগ্রভাগের দ্বারা স্পর্শ করির রহিল গঙ্গারাম তখন রমার নির্দোযিতা, আপনার মোক, লে! ভ, ফৌজদারের সহিত সাক্ষাৎ, কথোপকথন এবং বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্ট সমুদায় সবিস্তারে কহিল । জয়ন্তী তখন ত্ৰিশূল লক্টর খরপদে চলির গেল । গমনকালে সভাস্ত সকলেই ন তশিরে সেই দেবীতুল্য মূৰ্ত্তিকে প্রণাম করিল, সকলষ্ট ব্যস্ত হইয়। পথ ছাড়ির দিল । কেন্ড কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে ব! তাঙ্গার অনুসরণ করিতে সাহস পাইল না । সে কোন দিকে কোথায় চলিয়! গেল, কেহ সন্ধান করিল ন! । জয়ন্তী চলিয়। গেলে, রাজ গঙ্গারামকে সম্বোধন করির বলিলেন, “এখন তুমি আপন মুখে সকল অপরাধ স্বাঙ্কত ইষ্টলে । এরূপ কুতন্ত্রের মৃত্যু ভিন্ন অঙ্গ দণ্ড উপপৃক্ত নহে । অতএব তুমি রাজদণ্ডে প্রাণত্যাগ করিতে প্রস্তুত হও " গঙ্গারাম দ্বিরুক্তি করিল না । প্রহরীরা তাহাকে লষ্টয় গেল ! বধদণ্ডের আজ্ঞা শুনিয়া সকল লোক স্তম্ভিত হইয়াছিল । কেহ কিছু বলিল না ; নীরবে সকলে আপনার ঘরে ফিরিয়া গেল, গৃহে গিয়া সকলেই রমাকে “সাক্ষাৎ লক্ষ্মী” বলির প্রশংস। করিল । সমার আর কোন কলঙ্ক রঙ্গিল ন । চতুর্থ পরিচ্ছেদ রাজ মুরলাকে মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়, নগরের বাহির করিয়া দিবার আদেশ করিলেন । সে হুকুম তখনই তামিল হইল । মুরলার নির্গমনকালে একপাল ছেলে এবং অন্তত রসিক লোক দল বধিয়া করতালি দিতে দিতে এবং গীত গায়িতে গায়িতে চলিল । * গঙ্গারামের ন্যায় কৃতন্ত্রের পক্ষে, শূলদণ্ড ভিন্ন অন্ত দণ্ড তখনকার রাজনীতিতে ব্যবস্থিত ছিল না । অতএব তাহার প্রতি সেই আজ্ঞাই হইল । কিন্তু গঙ্গারামের মৃত্যু আপাততঃ দিনকতক স্থগিত রাখিতে হইল ।