পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

করিলেন। বলিলেন, “উহাদের চরিত্র ভাল নহে ; সঙ্গে যাইও না । উহাদের কি মতলব বলা যায়- না । আমি ভদ্রসন্তান হইয়া তোমার স্থায় স্বন্দরীকে পুরুষের সঙ্গে কোথাও পাঠাইতে পারি না।” সুতরাং আমি নিরস্ত হইলাম । এক দিন শুনিলাম যে, ঐ গ্রামের কৃষ্ণদাস বসু নামক এক জন ভদ্রলোক সপরিবারে কলিকাতায় যাইবেন । শুনিয়া আমি উত্তম সুযোগ মনে করি লাম । কলিকাতা হইতে আমার পিত্ৰালয় এবং শ্বশুরালয় অনেক দূর বটে, কিন্তু সেখানে আমার জ্ঞাতি খুল্লতাত বিষয়কৰ্ম্মোপলক্ষে বাস করিতেন। আমি ভাবিলাম যে, কলিকাতায় গেলে অবশ্ব খুল্লতাতের সন্ধান পাইব । তিনি অবশু আমাকে পিরালয় পাঠাইয়া দিবেন । না হয়, আমার পিতাকে সংবাদ দিবেন । আমি এই কথ। ব্রাহ্মণকে জানাইলাম । ব্রাহ্মণ বলিলেন, “এ উত্তম বিবেচনা করিয়াছ, ক্লষ্ণদাস বাবু আমার যজমান : সঙ্গে করিয়া লইয়। বলিয়। দিয়া আসিব । তিনি প্রাচীন আর বড় ভাল মানুষ ।” ব্রাহ্মণ আমাকে কৃষ্ণদাস বাবুর কাছে লইয়। গেলেন । ব্রাহ্মণ বলিলেন, “একটি ভদ্রলোকের কন্য, বিপাকে পড়িয়া পথ হারাষ্টয়া এ দেশে আসিয় পড়ি য়াছেন । আপনি যদি ইহাকে সঙ্গে লইয়া যান, তবে এ অনাথ আপনার পিত্রালয়ে পৌছিতে পারে ” কৃষ্ণদাস বাবু সন্মত হইলেন । আমি তাহার অন্তঃ পুরে গেলাম। পরদিন তাহার পরিবারস্থ স্ত্রীলোক দিগের সঙ্গে বসু মহাশয়ের পরিবার কর্তৃক অনাদৃত হুইয়াও, কলিকাতায় যাত্রা করিলাম। প্রথম দিন চারি পাঁচ ক্রোশ ছাটিয়া গঙ্গাতীরে অসিতে হইল । পরদিন নৌকায় উঠিলাম। পঞ্চম পরিচ্ছেদ বাজিয়ে যাব মল অামি গঙ্গ। কখনও দেখি নাই । এখন গঙ্গ৷ দেখিয়া আহলদে প্রাণ ভরিয়া গেল—আমার এত দুঃখ মুহূর্তের জন্য সব ভুলিলাম। গঙ্গার প্রশস্ত হৃদয় ! তাহাতে ছোট ছোট ঢেউ—ছোট ঢেউয়ের উপর রৌদ্রের ঝিকিমিকি—যতদুর চক্ষু যায়, ততদূর জলিতে জলিতে ছুটিয়াছে—তীরে কুঞ্জের মত সাজান বৃক্ষের অনন্ত শ্রেণী ; জলে কত রকমের কত নৌকা ; জলের উপর দাড়ের শব্দ, দাড়িমাঝির শব্দ, জলের উপর কোলাহল, তীরে ঘাটে ঘাটে কোলাহল। কত রকমের কত লোক ; কত রকমে স্নান . করিতেছে । আবার কোথায় সাদা মেঘের মত অসীম সৈকতভূমি— তাতে কত প্রকারের পক্ষী কত শব্দ করিতেছে । গঙ্গা যথার্থ পুণ্যময়ী । অতৃপ্তনয়নে কয় দিন দেখিতে দেখিতে আসিলাম । যে দিন কলিকাতায় পৌছিব, তাহার পূর্বদিন সন্ধ্যার কিছু পূৰ্ব্বে জোয়ার আসিল । নৌকা আর গেল না । একখানা ভদ্রগ্রামের একটা বাধা ঘাটের নিকট আমাদের নৌকা লাগাইয়া রাখিল । কত সুন্দর জিনিস দেখিলাম। জেলেরা মোচার খোলার মত ডিঙ্গীতে মাছ ধরিতেছে দেখিলাম। ব্রাহ্মণপণ্ডিত ঘাটের রাণায় বসিয়া শাস্ত্রীয় বিচার করিতেছেন দেখিলাম । কত সুন্দরী বেশভূষা করিয়া জল লইতে আসিল । কেহ জল ফেলে, কেহ কলসী পূরে, কেহ আবার ঢালে আবার কলসী পূরে, আর হাসে, গল্প করে, আবার ফেলে, আবার কলসী ভরে । দেখিয়া আমার প্রাচীন গীতটি মনে পড়িল । এক কাকে কুম্ভ করি, কলসীতে জল ভরি, জলের ভিতর খামরায় । - কলসীতে দিতে ঢেউ, আর ন| দেখিলাম কেউ, পুন কানু জলেতে লুকায় ॥ সেই দিন সেইখানে দুইটি মেয়ে দেখিয়াছিলাম, তাহাদের কখন ভুলিব না। মেয়ে দুইটির বয়স সাত আট বৎসর । দেখিতে বেশ, তবে পরম সুন্দরীও নয় । কিন্তু সাজিয়াছিল ভাল। কানে ফুল, হাতে আর গলায় এক একখানি গহন । ফুল দিয়া খোপা বেড়িয়াছে। রঙ্গ-কর। শিউলিফুলে ছোবান দুইখানি কালাপেড়ে কাপড় পরিয়াছে । পায়ে চারিগাছি করিয়া মল আছে । কাকালে ছোট ছোট দুইটি কলসী আছে। তাহার ঘাটের রাণায় নামিবার সময়ে জোয়ারের জলের একটা গান গাহিতে গাহিতে নামিল। গানটি মনে আছে, মিষ্ট লাগিয়াছিল, তাই এখানে লিখিলাম। এক জন এক এক পদ গায়, আর এক জন দ্বিতীয় পদ গায় । তাহাদের নাম শুনিলাম, অমল। আর নিৰ্ম্মলা । প্রথমেই গাইল— . অমল । ধানের ক্ষেতে, ঢেউ উঠেছে, বঁাশতলাতে জল । আয় আয় সই, জল আনি গে, জল আনি গে চল ।