পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হাসিতে হাসিতে আমি গিল্পীর কাছে গিয়া আবার পাকাচুল তুলিতে বসিলাম। দুই চারিগাছ তুলিয়া বলিলাম, “কৈ, আর বড় পাকা দেখিতে পাই না। দুই একগাছ রহিল, কাল তুলে দিব।” মাগী এক গাল হাসিল । বলিল, “আবার বেটীর। বলে সব চুলই পাক৷ ” সে দিন আমার আদর বাড়িল । কিন্তু যাহাতে দিন দিন বসিয়া বসিয়া পাক চুল তুলিতে না হয়, সে ব্যবস্থা করিব মনে মনে স্থির করিলাম, বেতনের টাক। পাইয়াছিলাম, তাহ হইতে একটা টাক। হারাণীর হাতে দিলাম ; বলিলাম, “একটা টাকায় এক শিশি কলপ কারও হাত দিয়া কিনিয়া আনিয়া দে ।” হারাণী হাসিয়া কুটপাট । হাসি থামিলে বলিল, কলপ নিয়ে কি করবে গা ? কার চুলে দেবে ?" আমি । বামুন ঠাকুরাণীর । এবার হারাণী হাসিতে হাসিতে বসিয়া পড়িল । এমন সময়ে বামুন ঠাকুরাণী সেখানে আসিয়া পড়িল । তখন সে হাসি থামাইবার জন্ত মুখে কাপড় গুজিয়। দিতে লাগিল। কিছুতেই থামাইতে না পারিয়া সেখান হইতে পলাইয়া গেল । বামুন ঠাকুরাণী বলিলেন, “ও অত হাসিতেছে কেন ?” আমি বলিলাম, “ওর অন্য কাজ ত দেখি না। এখন আমি বলিয়াছিলাম যে, বামুন ঠাকুরাণীর চুলে কলপ দিলে ভাল হয় না ? তাই আমন করছিল।” বামন-ঠা । ত৷ অত হাসি কিসের ? দিলেই বা, ক্ষতি কি ? শোণের কুড়ি, শোণের কুড়ি ব’লে ছেলেগুলা ক্ষেপায়, তা সে দায়ে ত বঁচিব । স্বভাষিণীর মেয়ে আমনই আরম্ভ করিল— —“চলে বুড়ী শোণের তুড়ী গোপায় বাধা চুল । গলায় দড়ী কানে জোড়া ছল ” হাতে নড়ি হেমার ভাই বলিল, “জোলা দুম্ " তখন কাহারও উপর জোলা চুম্ পড়িবে আশঙ্কায় স্বভাষিণী তাহাকে সরাইয়া লইয়া গেল । বুঝিলাম, বামনীর কলপে বড় ইচ্ছা । বলিলাম, *আচ্ছা, আমি কলপ দিয়া দিব ।” বামনী বলিল, “আচ্ছা, তাই দিয়া দিও । তুমি বেঁচে থাক, তোমার সোনার গহনা হোক । তুমি খুব রাধতে শেখ ” হারাণী হাসে, কিন্তু কাজের লোক। শীঘ্র এক শিশি উত্তম কলপ আনিয়া দিল । আমি তাহ হাতে করিয়া গিল্পীর পাকা চুল তুলিতে গেলাম।: গিরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাতে কি ও ?” . আমি বলিলাম, “একটা আরক। এটা চুলে মাখাইলে সব পাকা চুল উঠিয়৷ আসে, কাচা চুল থাকে ।” গৃহিণী বলিলেন, “বটে, এমন আশ্চৰ্য্য আরক ত কখন শুনি নাই । ভাল, মাখাও দেখি । দেখিও, কলপ দিও না যেন ।” আমি উত্তম করিয়া তাহার চুলে কলপ মাখাইয়া দিলাম। দিয়া পাক। চুল আর নাই, বলিয়া চলিয়৷ গেলাম। নিয়মিত সময় উত্তীর্ণ হইলে তাহার সমস্ত চুলগুলি কাল হইয়া গেল । দুর্ভাগ্য বশতঃ হারাণী ঘর ঝাঁট দিতে দিতে তাহ দেখিতে পাইল । তখন । সে ঝাটা ফেলিয়া দিয়া, মুখে কাপড় গুজিয়া হাসিতে হাসিতে সদর-বাড়ী চলিয়। গেল । সেখানে “কি ঝি ?” “কি কি ?” এই রকম একটা গোলযোগ উপস্থিত হইলে, সে আবার ভিতরবাড়ীতে আসিয়া মুখে কাপড় গুজিতে গুজিতে ছাদের উপর চলিয়া গেল । সেখানে সোনার মা চুল শুকাইতেছিল ; সে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হয়েছে ?” হারাণী হাসির জালায় কথা কহিতে পারিল না ; কেবল হাত দিয়া • মাথা দেখাইতে লাগিল । সোনার মা কিছু বুঝিতে না পারিয়া, নীচে আসিয়া দেখিল যে, গৃহিণীর মাথার চুল সব কাল—সে ফুকরিয়া কাদিয়া উঠিল । বলিল, —“ও মা ! এ কি হলো গো ! তোমার মাথার সব চুল কালে হয়ে গেছে গো ! ও মা ! কে না জানি তোমায় ওষুধ করিল ” এমন সময়ে সুভাষিণী আসিয়া আমাকে পাকড়াইল—হাসিতে হাসিতে বলিল, “পোড়ারমুখী, ও করেছ কি, মা’র চুলে কলপ দিয়াছে ?” আমি । হু । সুভা । তোমার মুখে আগুন ! কি কাণ্ড হয় দেখ ! আমি । তুমি নিশ্চিন্ত থাক । এমন সময়ে গৃহিণী স্বয়ং আমাকে তলব করিলেন ; বলিলেন, হঁ। গা কুমো ! তুমি কি আমার মাথায় কলপ দিয়াছ ?” দেখিলাম, গৃহিণীর মুখখানা বেশ প্রসন্ন । আমি বলিলাম, “আমন কথা কে বল্লে মা ?” গৃ । এই যে সোনার মা বল্‌ছে । আমি । সোনার মা'র কি ? ও কলপ নয় মা, আমার ওষুধ ।