পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RR' স্বামীকে 'উপেন্দ্র’ বলিতে আরম্ভ করিব ? না, *প্রাণনাথ” “প্রাণকাস্ত” “প্ৰাণেশ্বর” “প্রাণপতি" এবং “প্রাণাধিকের" ছড়াছড়ি করিব ? যিনি আমাদিগের সৰ্ব্বাপেক্ষ প্রিয় সম্বোধনের পাত্র, যাহাকে পলকে পলকে ডাকিতে ইচ্ছা করে, তাহাকে যে কি বলিয়া ডাকিব, এমন কথা পোড়া দেশের ভাষায় নাই । আমার এক সর্থী ( দাসগণের অনুকরণ করিয়া ) স্বামীকে “বাবু বলিয়া ডাকিত—কিন্তু শুধু বাবু, বলিতে তাহার মিষ্ট লাগিল না—সে মনোদুঃখে স্বামীকে শেষে “বাবুরাম” বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিল। আমারও ইচ্ছা করিতেছে, আমি তাই করি । মাংসপাত্র ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়া মনে মনে স্থির করিলাম, “যদি বিধাতা হারাধন মিলাইয়াছেন—তবে ছাড়া হবে না। বালিকার মত লজ্জা করিয়া সব নষ্ট না করি ” এই ভাবিয়া আমি এমত স্থানে দাড়াইলাম যে, ভোজনস্থান হইতে বহিৰ্ব্বাটীতে গমনকালে যে এদিক্‌ ওদিকৃ চাহিতে চাহিতে যাইবে, সে দেখিতে পাইবে । আমি মনে মনে বলিলাম যে, “যদি ইনি এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে না যান, তবে আমি এ কুড়ি বৎসর বয়স পর্য্যন্ত পুরুষের চরিত্র কিছুই বুঝি নাই ।” আমি স্পষ্ট কথা বলি, তোমরা অামাকে মার্জন। করিও—আমি মাথার কাপড় বড় খাটো করিয়া দিয়া দাড়াইয়াছিলাম। এখন লিখিতে লজ্জা করিতেছে, কিন্তু তখন আমার কি দায়, তাহ মনে করিয়া দেখ । অগ্রে অগ্রে রমণবাবু গেলেন : তিনি চারিদিক চাহিতে চাহিতে গেলেন, ষেন খবর লইতেছেন, কে কোথায় আছে । তার পর রামরাম দত্ত গেলেন – তিনি কোন দিকে চাহিলেস না । তার পর আমার স্বামী গেলেন–র্তাহার চক্ষু যেন চারিদিকে কাহার অমুসন্ধান করিতেছিল । আমি তাহার নয়নপথে পড়িলাম। র্তাহার চক্ষু আমারই অনুসন্ধান করিতেছিল, তাহা বিলক্ষণ জানিতাম । তিনি আমার প্রতি চাহিবামাত্র আমি ইচ্ছাপূৰ্ব্বক—কি বলিব, বলিতে লজ্জা করিতেছে—সপের যেমন চক্রবিস্তার স্বভাবসিদ্ধ, কটাক্ষ আমাদিগেরই তাই । যাহাকে আপনার স্বামী বলিয়া জানিয়াছিলাম, তাহার উপর একটু অধিক করিয়া বিষ ঢালিয়া না দিব কেন ? বোধ হয়, “প্রাণনাথ” আহত হইয়া বাহিরে গেলেন । আমি তখন হারাণীর শরণাগত হইব মনে করিলাম। নিভৃতে ডাকিবামাত্র সে হাসিতে হাসিতে আসিল । সে উচ্চ হাস্ত করিয়া বলিল, “পরিবেশনের বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী সময় বামন ঠাকুরাণীর নাকালটা দেখিয়াছিলে ?” উত্তরের অপেক্ষ না করিয়া সে আবার হাসির ফোয়ারা খুলিল । আমি বলিলাম, “তা জানি, কিন্তু আমি তার জন্য তোকে ডাকি নাই । আমার জন্মের শোধ একবার উপকার কর । ঐ বাবুট কখন যাইবেন, আমাকে শীঘ্র খবর আনিয়া দে ।” হারাণী একবার হাসি বন্ধ করিল। এত হাসি, যেন ধুয়ার অন্ধকারে আগুন-ঢাকা পড়িল । হারাণী গম্ভীরভাবে বলিল, “ছি দিদিঠাকৃরুণ! তোমার এ রোগ আছে, তা জানিতাম না ।” অামি হাসিলাম । বলিলাম, “মানুষের সকল দিন সমান যায় না। এখন তুই গুরুহামশয়গিরি রাখ– আমার এ উপকার করিবি কি না বল " হারাণী বলিল, “কিছুতেই আমা হতে এ কাজ হইবে না।” আমি খালি হাতে হারাণীর কাছে আসি নাই । মাহিয়ানার টাকা ছিল, পাঁচট। তাহার হাতে দিলাম । বলিলাম, “আমার মাথা খাস, এ কাজ তোকে করিতেই হুইবে ।” হারাণী টাকা কল্পট ছুড়িয়া ফেলিয়া দিতেছিল, কিন্তু তাহ। না দিয়া নিকটে উনান নিকাইবার এক ঝুড়ি মাটী ছিল, তাহার উপর রাখিয়। দিল । বলিল,—অতি গম্ভীরভাবে, আর হাসি নাই—“তোমার টাকা ছুড়িয়। ফেলিয়। দিতেছিলাম, কিন্তু শব্দ হইলে একটা কেলেঙ্কারী হুইবে, তাই আস্তে আস্তে এইখানে রাখিলাম—কুড়াইয়৷ লও । আর এ সকল কথা মুখে এনে না ।" আমি কাদিয়া ফেলিলাম ! হারাণী বিশ্বাসী, আর সকলে অবিশ্বাসী, আর কাহাকে ধরিব ? অামার কান্নার প্রকৃত তাৎপর্য্য সে জানিত না । তথাপি তার দয়া হইল । সে বলিল, “কাদ কেন ? চেনা মানুষ না কি ?” আমি একবার মনে করিলাম, হারাণীকে সব খুলিয়া বলি । তার পর ভাবিলাম, সে এত বিশ্বাস করিবে না, একটা বা গণ্ডগোল করিবে । ভাবিয়া চিন্তিয়া স্থির করিলাম, সুভাষিণী ভিন্ন আমার গতি নাই । সেই আমার বুদ্ধি, সেই আমার রক্ষাকারিণী —তাহাকে সব খুলিয়া বলিয়া পরামর্শ করি গিয়া । হারাণীকে বলিলাম, “চেনা মানুষ বটে—বড় চেনা, সকল কথা শুনিলে তুই বিশ্বাস করিবি না, তাই তুলনা আদালন কিছু দোব s”