পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

રક્ત পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ কুলের বাহির তখন সে চিন্তিত ভাব আমার দূর হইল । ইতিপূৰ্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, তিনি আমার বশীভূত হইয়াছেন । মনে মনে কহিলাম, যদি গণ্ডারের খড়গ-প্রয়োগে পাপ না থাকে, যদি হস্তীর দস্তপ্রয়োগে পাপ না থাকে, যদি ব্যান্ত্রের নখব্যবহারে পাপ না থাকে, যদি মহিষের শুঙ্গাঘাতে পাপ না থাকে, তবে আমারও পাপ হইবে না । জগদীশ্বর আমাদিগকে যে সকল অয়ুধ দিয়াছেন, উভয়ের মঙ্গলার্থ তাহ প্রয়োগ করিব । যদি কখন ‘মল বাজিয়ে যেতে হয়, তবে সে এখন । আমি তাহার নিকট হইতে দূরে আসিয়া বসিলাম । তার সঙ্গে প্রফুল্ল হইয়া কথা কহিতে লাগিলাম । তিনি নিকটে আসিলেন, আমি তাহাকে কহিলাম, “আমার নিকটে আসিবেন না, আপনার একটি ভ্রম জন্মিয়াছে দেখিতেছি । [ হাসিতে হাসিতে আমি এই কথা বলিলাম এবং বলিতে বলিতে কবরী মোচন পূৰ্ব্বক (সত্যকথা বলিলে, কে এ ইতিহাস বুঝিতে পারিবে ? ) আবার-বাধিতে বাধিতে বলিলাম } “আপনার একটি ভ্রম জন্মিয়াছে । আমি কুলটা নাই । আপনার নিকটে দেশের সংবাদ শুনিব বলিয়াই আসিয়াছি । অসৎ অভিপ্রায় কিছুই নাই ।” বোধ হয়, তিনি এ কথা বিশ্বাস করিলেন ন । অগ্রসর হইয়া বসিলেন । আমি তখন হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “তুমি কথা শুনিলে না, তবে আমি চলিলাম, তোমার সঙ্গে এই সাক্ষাৎ ” এই বলিয়া আমি যেমন করিয়া চাহিতে হয়, তেমনি করিয়া চাহিতে চাহিতে আমার কুঞ্চিত, মস্বণ, সুবাসিত অলকদামের প্রান্তভাগ যেন অনবধানে তাঙ্কার গণ্ডস্পর্শ করাইয়া সন্ধ্যার বাতাসে বসন্তের লতার মত একটু হেলিয়া, গাত্ৰোখান করিলাম। অামি সত্যই গাত্রাথান করিলাম দেখিয়া তিনি ক্ষুণ্ণ হইলেন, আসিয়া আমার হাত ধরিলেন । তিনি হাতখান ধরিয়ী রাখিয়া যেন বিস্মিতের মত হাতের পানে চাহিয়া রহিলেন । আমি বলিলাম, “দেখিতেছ কি ?” তিনি উত্তর করিলেন, “এ কি ফুল ? এ ফুল ত মানায় নাই । ফুলটার অপেক্ষ মানুষটা সুন্দর । মল্লিকাফুলের চেয়ে মানুষ স্বন্দর । এই প্রথম দেখিলাম । আমি রাগ করিয়া হাত ছড়িয়া ফেলিয়া দিলাম ; কিন্তু হাসিলাম, বলিলাম, “তুমি বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী ভাল মানুষ নও। আমাকে ছুইও না, আমাকে দৃশ্চরিত্রা মনে করিও না ।” এই বলিয়। আমি দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলাম । স্বামী—অদ্যাপি সে কথা মনে পড়িলে দুঃখ হয়— তিনি হাতযোড় করিয়া ডাকিলেন, “আমার কথা রাখ, যাইও না । আমি তোমার রূপ দেখিয়া পাগল হইয়াছি । এমন রূপ আমি কখনও দেখি নাই, আর একটু দেখি। এমন আর কখন দেখিব না।” আমি আবার ফিরিলাম—কিন্তু বসিলাম না—বলিলাম, “গ্র:ণাধিক ! আমি কোন ছার, আমি যে তোমা হেন রত্ন ত্যাগ করিয়া যাইতেছি, ইহাতেই আমার মনের দুঃখ বুঝিও ! কিন্তু কি করিব ? ধৰ্ম্মই আমাদের একমাত্র প্রধান ধন-এক দিনের সুখের জষ্ঠ আমি ধৰ্ম্ম ত্যাগ করিব না । আমি না বুঝিয়া, ন। ভাধিয়া, আপনার কাছে আসিয়াছি, না বৃঝিয়া, না ভাবিয়া, আপনাকে পত্র লিখিয়াছিলাম । কিন্তু আমি একেবারে অধঃপাতে ঘাই নাই । এখনও আমার রক্ষার পথ খোলা আছে, আমার ভাগ্য যে, সে কথা এখন তামার মনে পড়িল । আমি চলিলাম ।” তিনি বলিলেন, “তোমার ধৰ্ম্ম তুমি জান । আমায় এমন দশায় ফেলিয়াছ যে, আমার আর ধৰ্ম্মাধৰ্ম্মজ্ঞান নাই। আমি শপথ করিতেছি, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়েশ্বরী হইয়া থাকিবে । এক দিনের জন্ত মনে করিও না ।” আমি হাসিয়া বলিলাম, “পুরুষের শপথে বিশ্বাস নাই। এক মুহূৰ্বের সাক্ষাতে কি এত হয় ?” এই বলিয়া আবার চলিলাম—দ্বার পর্য্যন্ত আসিলাম, তখন আর ধৈর্য্যাবলম্বন করিতে ন পারিয়া তিনি দুই হস্তে আমার দুই চরণ ধরিয়৷ পথরোধ করিলেন । বলিলেন, “আমি এমন যে আর কখন দেখি নাই ।” তাহার মৰ্ম্মভেদী দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল । তাহার দশা দেখিয়া আমার দুঃখ হইল। বলিলাম, “তবে তোমার বাসায় চল—এখানে থাকিলে তুমি আমায় ত্যাগ করিয়া যাইবে ।” তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন । তাহার বাসা সিমলায়, অল্পদুর । র্তার গাড়ীও হাজির ছিল এবং দ্বারবানের নিদ্রিত। আমরা নিঃশব্দে দ্বার খুলিয়া গাড়ীতে গিয়া উঠিলাম। র্তার বাসায় গিয়া দেখিলাম, দুই মহল বাড়ী। একটি ঘরে আমি অগ্ৰে প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিয়াই ভিতর হইতে অর্গল রুদ্ধ করিলাম। স্বামী বাহিরে পড়িয়া রছিলেন ।