পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৬ সঙ্গের লোকজন আমাকে মহেশপুর লইয়া গেল, গ্রামের বাহিরে বাহুক ও রক্ষকদিগকে অবস্থিতি করিতে বলিয়া আমি পদব্রজে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ" করিলাম। পিতার গৃহ সম্মুখে দেখিয়া, এক নির্জন স্থানে বসিয়া অনেক রোদন করিলাম । তাহার পর গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলাম । সম্মুখেই পিতাকে দেখিয়া প্রণাম করিলাম । তিনি আমাকে চিনিতে পারিয়া আহলাদে বিবশ হইলেন । সে সকল কথা এখানে বলিবার অবসর নাই । আমি এত দিন কোথায় ছিলাম, কি প্রকারে আসিলাম—তাহা কিছুই বলিলাম না । পিতা-মাতা জিজ্ঞাসা করিলে বলিলাম, “এর পর বলিব ।” সময়াস্তরে স্থূলকথা তাহাদিগকে বলিলাম কিন্তু সব কথা নহে। এতটুকু বুঝিতে দিলাম যে, পরি শেষে আমি স্বামীর নিকটেই ছিলাম, স্বামীর নিকট হইতেই আসিয়াছি এবং তিনিও দুই এক দিনের মধ্যে এখানে আসিবেন । সব কথা ভাঙ্গিয়৷ চুরিয়৷ কামিনীকে বলিলাম। কামিনী আমার অপেক্ষ দুই বৎসরের ছোট, বড় রঙ্গ ভালবাসে । সে বলিল, *দিদি ! ৰখন মিত্ৰজা এত বড় গোবর-গণেশ, তাকে নিয়ে একটু রঙ্গ করিলে হয় না ?” আমি বলিলাম, “আমারও সেই ইচ্ছা ।” তখন দুই বহিনে পরামর্শ অঁাটিলাম। সকলকে শিখাইয়। ঠিক করিলাম । বাপ মাকেও একটু শিখাইতে হইল। কামিনী র্তাহাদিগকে বুঝাইল যে, প্রকাশ্বে গ্রহণ করাট এখনও হয় নাই, সেট। এইখানেই হইবে । আমরাই তাহ করিয়া লইব । তবে আমি যে এখানে আসিয়াছি, এ কথাটা র্তাহারা জামাত আসিলে তাহার সাক্ষাতে প্রকাশ না করেন । পরদিন জামাতা আসিলেন । পিতামাত। র্তাহাকে যথেষ্ট আদর অপেক্ষা করিলেন । আমি আসিয়াছি, এ কথা বাহিরে কাহারও মুখে তিনি শুনিলেন না । কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না । ষখন অন্তঃপুরে জলযোগ করিতে আসিলেন, তখন বড় বিষণ্ণবদন । জলযোগের সময় আমি সম্মুখে রছিলাম না । কামিনী বসিল, আর দুই চারি জন জ্ঞাতিভগিনী ভাইজ বসিল । তখন সন্ধ্যাকাল উত্তীর্ণ হইয়াছে, কামিনী অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল । তিনি যেন কলে উত্তর দিতে লাগিলেন ; আমি আড়ালে দাড়াইয়া সব শুনিতে দেখিতে লাগিলাম। পরিশেষে তিনি কামিনীকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমার দিদি কোথায় ?” বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী কামিনী খুব একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “কি জানি কোথায় ? কালাদীঘিতে সেই যে সৰ্ব্বনাশটা হইয়া গেল, তার পর ত আর কোন খবর পাওয়া যায় নাই ।” র্তার মুখখান বড় লম্বা হইয়া গেল, কথা আর কহিতে পারেন না। বুঝি কুমুদিনীকে হারাইলাম, এ কথা মনে করিয়! থাকিবেন, কেন না, তার চক্ষু দিয়া দরবিগলিত ধারা বহিতে লাগিল । চক্ষের জল সামলাইয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুমুদিনী বলিয়া কোন স্ত্রীলোক আসিয়াছিল কি ?” কামিনী বলিল “কুমুদিনী কি কে, তাহ বলিতে পারি ন একট। স্ত্রীলোক পরশুদিন পান্ধী করিয়া আসিয়াছিল বটে। সে বরাবর মহাভৈরবীর মন্দিরে গিয়া উঠিয়া দেবীকে প্রণাম করিল। অমনি একটা আশ্চৰ্য্য ব্যাপার উপস্থিত হইল, হঠাৎ মেঘ অন্ধকার হইয়। ঝড়বৃষ্টি হইল । সেই স্ত্রীলোকট। সেই সময় ত্ৰিশূল হাতে করিয়৷ জলিতে জলিতে আকাশে উঠিয়৷ কোথায় চলিয়া গেল।” প্রাণনাথ জলযোগ ত্যাগ করিলেন । হাত ধুইয়া মাথায় হাত দিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিলেন, অনেক ক্ষণ পরে বলিলেন, “বে স্থান হইতে কুমুদিনী অন্তৰ্দ্ধান করিয়াছে, তাহ দেখিতে পাই না ?” কামিনী বলিল, “পাও বৈ কি । অন্ধকার হয়েছে -–আলো নিয়ে আসি ।" এই বলিয়া কামিনী আমাকে ইঙ্গিত করিয়া গেল— “আগে তুই যা । তার পর আলো নিয়ে উপেন্দ্র । বাবুকে লইয়। যাইব ।" আমি আগে মন্দিরে গিয়া বারেন্দায় বসিয়া রহিলাম । সেইখানে আলো ধরিয়া ( খিড়কি দিয়া পথ আছে বলিয়াছি ) কামিনী আমার স্বামীকে আমার কাছে লইয়া আসিল । তিনি আসিয়া আমার পদপ্রান্তে আছাড়িয়া পড়িলেন। ডাকিলেন, “কুমুদিনি, কুমুদিনি ! যদি—আসিয়াছ—ত আর আমায় ত্যাগ করিও না ” তিনি বার দুই চারি এই কথা বলার পর কামিনী চটিয়া উঠিয়া বলিল, “আয় দিদি ! উঠে আয় । ও মিন্‌ষে কুমুদিনী চেনে, তোকে চেনে না " - তিনি ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি ! দিদি কে ?” কামিনী রাগ করিয়া বলিল, ইন্দিরে । কখনও নাম শোন নি ?” এই বলিয়া দুষ্ট কামিনী আলোটা নিবাইয়৷ দিয়৷ আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া আসিল । আমরা “আমার দিদি