পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভূগেশনন্দিনী হইয়াছে ; কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। যাহা অদৃষ্টে থাকে, পশ্চাৎ ঘটবে, বিধাতার লিপি কে খণ্ডাইবে ? এখন কেবল আমার মন ব্যক্ত করিয়া কহিতে পারি। এই শৈলেশ্বর-সাক্ষাৎ সত্য করিতেছি যে, তিলোত্তম ব্যতীত অন্ত কাহাকেও ভালবাসিব না। তোমার কাছে আমার এই ভিক্ষা যে, তুমি আমার সকল কথা তোমার সখীর সাক্ষাতে কহিও, আর কহিও যে, আমি কেবল একবারমাত্র র্তাহার দর্শনের ভিখারী, দ্বিতীয়বার আর এ ভিক্ষা করিব না, স্বীকার করিতেছি ।” বিমলার মুখ হর্যোৎফুল্ল হইল। তিনি কহিলেন, “আমার সখীর প্রত্যুত্তর মহাশয় কি প্রকারে পাইবেন ?” যুবরাজ কছিলেন, “তোমাকে বারংবার ক্লেশ দিতে পারি না, কিন্তু যদি তুমি পুনৰ্ব্বার এই মন্দিরে আমার সহিত সাক্ষাৎ কর, তবে তোমার নিকট বিক্রীত থাকিব । জগতসিংহ হইতে কথন না কখন প্রত্যুপকার হইতে পরিবে ।” বিমলা কহিলেন, “যুবরাজ ! আমি আপনার আজ্ঞানুবৰ্ত্তিনী ; কিন্তু একাকিনী রাত্রে এ পথে আসিতে অভ্যন্ত ভয় পাষ্ট, অঙ্গীকার পালন না করিলেই নয়. এ জন্যই আজ আসিয়াছে । এক্ষণে এ প্রদেশ শক্রব্যস্ত হইয়াছে, পুনৰ্ব্বার আসিতে বড় ভয় পাইব ।” রাজপুত্র ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন, “তুমি যদি হানি বিবেচনা না কর, আমি তোমার সহিত গড়মাণারণে যাই । আমি তথায় উপযুক্ত স্থানে অপেক্ষা করিব, তুমি আমাকে সংবাদ আনিয়া দিও ” বিমলা হৃষ্টচিত্তে কহিলেন,—“তবে চলুন।" উভয়ে মন্দির হইতে নির্গত হইয়া ষান, এমন সময়ে মন্দিরের বাহিরে সাবধান-দ্যস্ত মনুষ্য-পদ বিক্ষেপের শব্দ হইল। রাজপুত্র কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইয়া বিমলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“তোমার কেহ সমভিব্যাহারী আছে ?” বিমলা কহিলেন, “না।”

  • তবে কার পদধ্বনি হুইল ? আমার আশঙ্কা হইতেছে, কেহ অন্তরাল হইতে আমাদিগের কথোপকথন শুনিয়াছে * -

এই বলিয়া রাজপুত্র বাহিরে আসিয়া মন্দিরের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করিয়া দেখিলেন, কেহ কোথাও নাই । সপ্তদশ পরিচ্ছেদ বীরপঞ্চমী উভয়ে শৈলেশ্বরকে প্রণাম করিয়া সশঙ্কচিত্তে গড়মান্দারণ অভিমুখে যাত্রা করিলেন । কিঞ্চিৎ নীরবে গেলেন । কিছু দূর গিয়া রাজকুমার প্রথমে কথা কহিলেন,—“বিমলা, আমার এক বিষয়ে কৌতুহল আছে । তুমি শুনিয়া কি বলিবে, বলিতে পারি না।” বিমলা কহিলেন, “কি ?” জ। আমার মনে প্রতীতি জন্মিয়াছে, তুমি কদাপি পরিচারিকা নও। বিমলা ঈষৎ হাসিয়া আপনার মনে কেন জন্মিল ?” জ। বীরেন্দ্রসিংহের কন্যা যে অস্বরপতির পুত্রবধু হইতে পারে না, তাহার বিশেষ কারণ আছে । সে অতি গুহ বৃত্তাস্ত, তুমি পরিচারিক হইলে সে গুহ কাহিনী কি প্রকারে জানিবে ? বিমলা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন । কিঞ্চিৎ কাতরস্বরে কহিলেন,—“আপনি যথার্থ অনুভব করিয়াছেন ; আমি পরিচারিক নহি । অদৃষ্টক্রমে পরিচারিকার ন্যায় আছি। অদৃষ্টকেই বা কেন দোষি ? আমার অদৃষ্ট মন্দ নতে ” রাজকুমার বুঝিলেন যে, এই কথায় বিমলার মনোমধ্যে পরিতাপ উদয় হইয়াছে ; অতএব তৎ সম্বন্ধে আর কিছু বলিলেন না । বিমলা স্বতঃ কহিলেন, “যুবরাজ, আপনার নিকট পরিচয় দিব, কিন্তু এক্ষণে নয় । ও কি শব্ব ? পশ্চাৎ কেহ আসিতেছে ?” এই সময়ে পশ্চাৎ পশ্চাৎ মনুষ্যের পদধ্বনি স্পষ্ট শ্রুত হইল। এমন বোধ হইল, ষেন দুই জন মনুষ্য কাণে কাণে কথা কহিতেছে । তখন মন্দির হইতে প্রায় অৰ্দ্ধক্রোশ অতিক্রম হইয়াছিল । রাজপুত্র কহিলেন,--“আমার অত্যন্ত সন্দেহ হইতেছে, আমি দেখিয়া আসি ” এই বলিয়া রাজপুত্র কিছু পথ প্রত্যাবর্তন করিয়া দেখিলেন এবং পথের পাশ্বেও অনুসন্ধান করিলেন, কোথাও মনুষ্য দেখিতে পাইলেন না। প্রত্যাগমন করিয়া বিমলাকে কহিলেন,—“আমার সন্দেহ হইতেছে, কেহ আমাদের পশ্চাদ্বত্তী হইয়াছে। সাবধানে কথা কহা ভাল।" এখন উভয়ে অতি মৃদুস্বরে কথা কহিতে কহিতে চলিলেন । ক্রমে গড়-মান্দারণ গ্রামে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, “এ সন্দেহ