পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ক্রিতীক্ষ্ম খণ্ড প্রথম পরিচ্ছেদ আয়েয জগতসিংহ যখন চক্ষুরুন্মীলন করিলেন, তখন দেখিলেন যে, তিনি সুরম্য হৰ্ম্ম্যমধ্যে পর্য)ঙ্কে শয়ন করিয়া আছেন । ষে ঘরে তিনি শয়ন করিয়া আছেন, তথায় যে আর কখন আসিয়াছিলেন, এমত বোধ হইল না । কক্ষটি অতি প্রশস্ত, অতি সুশোভিত, প্রস্তরনিৰ্ম্মিত হস্ম্যতল পাদস্পর্শ সুখজনক গালিচায় আবৃত ; তদুপরি গোলাবপাশ প্রভৃতি স্বর্ণ-রৌপ্যগজদস্তাদি নানা মহাৰ্ঘ বস্তু-নিৰ্ম্মিত সামগ্রী রহিয়াছে । কক্ষদ্বারে বা গবাক্ষে নীল পর্দা আছে, এ জন্য দিবসের আলোক অতি স্নিগ্ধ হইয়। কক্ষে প্রবেশ করিতেছে । কক্ষ নানাবিধ স্নিগ্ধ সৌগন্ধে আমোদিত হইয়াছে। কক্ষমধ্য নীরব, যেন কেহই নাই । এক জন কিঙ্করী মুবাসিত বারিসিক্ত ব্যঞ্জনহুস্তে রাজপুত্রকে নিঃশব্দে বাতাস দিতেছে, অপর এক জন কিঙ্করী কিছু দূরে বাকশক্তিবিহীন চিত্ৰপুত্তলিকার স্তায় দণ্ডায়মানা আছে। যে দ্বিরদ-দস্তখচিত পালঙ্কে রাজপুল্ল শয়ন করিয়া আছেন তাহার উপরে রাজপুত্রের পার্শ্বে বসিয়া একটি স্ত্রীলোক তাহার অঙ্গের ক্ষতসকলে সাবধান-হস্তে কি ঔষধ লেপন করিতেছে । হৰ্ম্ম্যতলে গালিচার উপরে উত্তম পরিচ্ছদবিশিষ্ট এক জন পাঠান বসিয়া তাম্বুল চর্বণ করিতেছে ও একখানি পারসী পুস্তক দৃষ্টি করিতেছে। কেহই কোন কথা কহি তেছে না বা শব্দ করিতেছে না । রাজপুত্র চক্ষুরুন্মীলন করিয়। কক্ষের চতুদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন ; পাশ ফিরিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তিলাৰ্দ্ধ সরিতে পারিলেন না, সৰ্ব্বাঙ্গে দারুণ বেদন । পর্যাঙ্কে যে স্ত্রীলোক বসিয়াছিল, সে রাজপুত্রের উদ্যম দেখিয়া অতি মূছ বীণাবৎ মধুরস্বরে কহিল, “স্থির থাকুন, চঞ্চল হইবেন না।” রাজপুত্র ক্ষীণস্বরে কহিলেন—“আমি কোথায় ?" সেই মধুরস্বরে উত্তর হইল-“কথা কহিবেন না, আপনি উত্তম স্থানে আছেন । চিস্ত করিবেন.ন, কথা কহিবেন না ।" রাজপুত্র পুনশ্চ অতি ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বেলা কত ?” _. মধুরভাষিণী পুনরপি অন্মুটবচনে কহিল “অপরাহ্ল, আপনি স্থির হউন, কথা কহিলে আরোগ্য পাইতে পারিবেন না। আপনি চুপ না করিলে আমরা উঠিয়া शांठेत्र !" * রাজপুত্র কষ্টে কহিলেন,-“আর একটি কথা, তুমি কে ? রমণী কহিল –“আয়েয। " রাজপুত্ৰ নিস্তব্ধ হইয়া আয়েষার মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আর কোথাও কি ইহাকে দেখিয়াছেন ? না ; আর কখনও দেখেন নাই, সে বিষয় নিশ্চিত প্রতীতি হইল । আয়েষার বয়ঃক্রম দ্বাবিংশতি বৎসর হইবে । আয়েষা দেখিতে পরম মুন্দরী, কিন্তু সে রীতির সৌনর্যা দুষ্ট চারি শব্দে সেরূপ প্রকটিত করা দুঃসাধ্য । তিলোত্তমাও পরম রূপবতী, কিন্তু আয়েষার সৌন্দর্য্য সে রীতির নহে ; স্থিরযেীবন বিমলারও এ কাল পৰ্য্যস্ত রূপের ছটা লোকমনোমোহিনী ছিল ; আয়েষার রূপরাশি তদনুরূপ নহে । কোন কোন তরুণীর সৌন্দর্য বাসস্তী মল্লিকার স্তায় নবস্কুট, ব্রীড়া সস্কুচিত কোমল, নিৰ্ম্মল, পরিমলময় । তিলোত্তমার সৌন্দর্ঘ্য সেইরূপ । কোন রমণীর রূপ অপরাহ্লের স্থলপদ্মের ন্যায় ; নিৰ্ব্বাস, মুদ্রিতোমূখ, শুষ্কপল্লব, অথচ সুশোভিত, অধিক বিকসিত, অধিক প্রভাবিশিষ্ট, মধুপরিপূর্ণ। বিমল সেইরূপ সুন্দরী । আয়েষার সৌন্দর্য্য নবরবিকরফুল্ল জল নলিনীর ন্যায় ; সুবিকাশিত, সুবাসিত, রসপূর্ণ রৌদ্রপ্রদীপ্ত, না সস্কুচিত, না বিশুষ্ক; কোমল অথচ প্রোজ্জল ; পূর্ণ দল রাজি হইতে রৌদ্র প্রতিফলিত হইতেছে, অথচ মুখে হাসি ধরে না । পাঠক মহাশয়, “রূপের আলো” কখন দেখিয়াছেন ? না দেখিয়া থাকেন, শুনিয়া থাকিবেন । অনেক সুন্দরী রূপে “দশ দিক্ আলো” করে । শুনা যায়, অনেকের পুত্রবধূ ঘর আলো করিয়া থাকেন। ব্রজধামে আর নিশুম্ভের যুদ্ধে কালরূপেও আলো হইয়াছিল। বস্তুতঃ পাঠক মহাশয় বুঝিয়াছেন, “রূপের আলো” কাহাকে বলে ? বিমলা রূপে আলো করিতেন, কিন্তু সে প্রদীপের আলোর মত, একটু একটু মিট্‌মিটে,