পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8之 জগতসিংহ আবার কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিয়া কহিলেন -“বীরেন্দ্রসিংহের কি হইয়াছে ?” “বীরেন্দ্রসিংহ কারাগারে আবদ্ধ আছেন, অদ্য র্তাহার বিচার হইবে ।” জগতসিংহের মলিন মুখ আরও মলিন হইল । জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর আর পৌরবর্গ কি অবস্থায় আছে ?” আয়েষা উদ্বিগ্ন হইলেন । বলিলেন, “সকল কথ। আমি অবগত নহি ।” রাজপুত্র আপনা-আপনি কি বলিলেন । একটি নাম তাহার কণ্ঠনির্গত শুষ্টল, আয়েম। তাহা শুনিতে পাইলেন –“তিলোত্তম। " আয়েষা ধীরে ধীরে উঠিয় পাত্র হইতে ভিষগদত্ত সুস্বাদু ঔষধ আনিতে গেলেন : রাজপুত্র তাহার দোলামান কর্ণাভরণ-সংযুক্ত অলৌকিক দেহ-মহিমা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন । আল্বেয ঔষধ আনিলেন ; রাজপুত্র তাঙ্গ পান করিয়া কহিলেন, “আমি পীড়ার মোহে স্বপ্নে দেখিতাম, স্বৰ্গীয় দেবকল্প। আমার শিয়রে বসিয়া শুশ্রীল। করিতেছেন, সে তুমি, ন৷ তিলোত্তমা ?” আয়েষ কহিলেন, “আপনি ভিলোত্তমাকে স্বপ্নে দেখিয়া থাকিবেন ।” চতুর্থ পরিচ্ছেদ অবগুণ্ঠনবর্তী দুর্গঞ্জয়ের হৃষ্ট দিবস পরে, বেল প্রস্তরেকের সময় কতলু খাঁ নিজ-দুর্গমধ্যে দরবারে বসিয়াছেন । দুই দিকে শ্রেণীবদ্ধ হইয় পরিষদগণ দণ্ডায়মান আছে । সম্মুখস্থ ভূমিখণ্ডে বহুসহস্ৰ লোক নিঃশব্দে রহিয়াছে । অদ্য বীরেন্দ্রসিংহের দণ্ড হইবে । কয়েক জন শস্ত্রপাণি প্রহরী বীরেন্দ্ৰসিংহকে শুঙ্খলাবদ্ধ করিয়া দরবারে আনীত করিল। বীরেন্দ্ৰসিংহের মূৰ্ত্তি রক্তবর্ণ ; কিন্তু তাহাতে ভীতি চিহ্ন কিছুমাত্র নাই। প্রদীপ্ত চক্ষু হইতে অগ্নিকণা বিস্ফুরিত হইতেছিল । নাসিকারন্ধ বৰ্দ্ধিতায়তন হইয়। কম্পিত হইতেছিল, দন্তে অধর দংশন করিতেছিলেন। কভলু পার সম্মুখে আনীত হইলে কতলু খাঁ বীরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহ ! তোমার অপরাধের দণ্ড করিব। তুমি কি জন্য আমার বিরুদ্ধাচারী হুইয়াছিলে ?” বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী বীরেন্দ্ৰসিংহ নিজ লোহিত মূৰ্ত্তিপ্রকটিত ক্রোধ সংবরণ করিয়া কহিলেন, “তোমার বিরুদ্ধে কোন কৰ্ম্ম করিয়াছি, তাহ অগ্রে আমাকে বল ।” এক জন পারিষদ কহিল, “বিনীতভাবে কথা কহ ।” কতলু খ বলিলেন, “কি জন্য আমার আদেশমত আমাকে অর্থ আর সেনা পাঠাইতে অসম্মত হইয়াছিলে ?" বীরেন্দ্ৰসিংহ অকুতোভয়ে কহিলেন, “তুমি রাজবিদ্রোঙ্গ দস্থা, তোমাকে কেন অর্থ দিব ? তোমার কি জন্য সেনা দিব ?" দ্রষ্টবৰ্গ দেখিলেন, বীরেন্দ্র আপনার মুণ্ড আপনি ছেদনে উদ্যত হইয়াছেন । কতলু থার ক্রোধে কলেবর কম্পিত হইয়া উঠিল । তিনি সহসা ক্রোধ-সংবরণ করিবার ক্ষমতা অভ্যাসসিদ্ধ করিয়াছিলেন, এ জন্য কতক স্থিরভাবে কহিলেন, “তুমি আমার অধিকারে বসতি করিয়া কেন মোগলের সঙ্গিত মিলন করিয়াছিলে ?” বীরেন্দ্র কছিলেন, “তোমার অধিকার কোথা ?” কতলুগ আরও কুপিত হইয়া কহিলেন, “শোন দুরাত্মন, নিজ কৰ্ম্মোচিত ফল পাইবি । এখনও তোর জীবনের আশা ছিল, কিন্তু তুই নিৰ্ব্বেধ, নিজ দর্পে আপন বধের উদ্যোগ করিতেছিস ।” বীরেন্দ্ৰসিংহ সগৰ্ব্বে হাস্ত কহিলেন ; কহিলেন, “কতলু গ+—আমি তোমার কাছে যখন শৃঙ্খলাবদ্ধ হুইয়। আসিয়াছি, তখন দয়ার প্রত্যাশা করিয়া আসি নাই । তোমার তুল্য শক্রর দয়ায় যার জীবনরক্ষা, --তাতার জীবনে প্রয়োজন ? তোমাকে আশীৰ্ব্বাদ করিয়। প্রাণত্যাগ করিতাম ; কিন্তু তুমি আমার পবিত্র কুলে কালি দিয়াছ ; তুমি আমার প্রাণের অধিক ধনকে--" বীরেন্দ্ৰসিংহ আর বলিতে পারিলেন না, স্বর বদ্ধ হইয়া গেল, চক্ষু বাষ্পাকুল হইল, নিৰ্ভীক গৰ্ব্বিত বীরেন্দ্ৰসিংহ অধোবদন হুইয়া রোদন করিতে লাগিলেন । কতলু খাঁ স্বভাবতঃ নিষ্ঠুর ; এতদুর নিষ্ঠুর যে, পরপীড়ায় তাহার উল্লাস জন্মিত। দাম্ভিক বৈরীর ঈদৃশ অবস্ত দেখিয় তাহার-মুখ হৰ্ষোৎফুল্প হইল। কহিলেন, “বীরেন্দ্ৰসিংহ ! তুমি কি আমার নিকটে কিছুই যাজ্ঞা করিবে না ? বিবেচনা করিয়া দেখ, তোমার সময় নিকট ।” যে দুঃসহ সস্তাপাগ্নিতে বীরেন্দ্রের হৃদয় দগ্ধ হইতেছিল, রোদন করিয়া তাহার কিঞ্চিৎ শমত হইল ।