পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুর্গেশনন্দিনী রাজপুত্র গৰ্ব্বিতবচনে কহিলেন, “আপনার এ কুসুমশষ্যা ছাড়িয়া কারাগারের শিলাশয্যায় শয়ন করা রাজপুতেরা অমঙ্গল বলিয়া গণে না ।” - ওসমান কছিলেন, “শিলাশয্যা যদি অমঙ্গলের চরম হুইত, তবে ক্ষতি কি ?” রাজপুত্র ওসমানের প্রতি তীব্র দৃষ্টি করিয়া কহিলেন, “যদি কতলু গাকে সমুচিত দণ্ড দিতে না পারিলাম, তবে মরণেই বা ক্ষতি কি ?” ওসমান কহিলেন, “যুবরাজ ! সাবধান ! পাঠ। নের যে কথা, সেই কাজ ।” রাজপুত্র হাস্ত করিয়া কহিলেন, “সেনাপতি, আপুনি যদি আমাকে ভয়প্রদর্শন করিতে আসিয়৷ থাকেন, তবে যত্ন বিফল জ্ঞান করুন " ওসমান কহিলেন, “রাজপুত্র, আমরা পরস্পর সন্নিধানে এরূপ পরিচিত আছি যে, মিথ। বাগাড়ম্বর কাহারও উদেশ্ব হইতে পারে না । আমি আপনার নিকট বিশেষ কাৰ্য্যসিদ্ধির জন্য আসিয়াছি।” জগতসিংহ কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইলেন । “অনুমতি করুন।” ওসমান কহিলেন, “আমি এক্ষণে ধে প্রস্তাব করিব, তাঙ্গ কত পার আদেশমত কহিতেছি, জানিবেন ।" কহিলেন, জ । উত্তম । ও । শ্রবণ করুন । রাজপুত-পাঠানের যুদ্ধে উভয় কুল ক্ষয় হইতেছে । রাজপুত্ৰ কহিলেন, “পাঠানকুল ক্ষয় করাই যুদ্ধের উদ্দেশু ” ওসমান কহিলেন, “সত। বটে, কিন্তু উভস কুল নিপাত ব্যতীত একের উচ্ছেদ কত দূর সম্ভাবন, তাহাও দেখিতে পাইতেছেন । গড় মান্দারণ-জেতৃগণ নিতান্ত বলহীন নহে, দেখিয়াছেন ?” জগতসিংহ ঈষন্মাত্র সহাস্ত হইয়। কহিলেন, “র্তাহার কৌশলময় বটে ।” ওসমান কহিতে লাগিলেন, “ষাহাই হউক, আত্মগরিমা আমার উদ্দেশ্য নহে । মোগল সম্রাটের সহিত চিরদিন বিবাদ করিয়৷ পাঠানের উৎকলে তিষ্ঠান মুখের হইবে না । কিন্তু মোগল সম্রাটুও পাঠানদিগকে কদাচ নিজকরতলস্থ করিতে পারিবেন ন! । আমার কথা আত্মশ্লাঘ বিবেচন। করিবেন না । আপনি ত রাজনীতিজ্ঞ বটে, ভাবিয়া দেখুন, দিল্লী হইতে উৎকল কতদূর । দিল্লীশ্বর যেন মানসিংহের বাহুবলে এবার পাঠান জয় করিলেন ; কিন্তু কত দিন তাহার জয়-পতাকা এদেশে উড়িবে ? মহারাজ মানসিংহ সসৈন্য . পশ্চাৎ হইবেন, আর ২য়--৮ ¢ጫ উৎকলে দিল্লীশ্বরের অধিকার লোপ হইবে । ইতিপূৰ্ব্বেও ত আকবর শাহ উৎকল জয় করিয়াছিলেন, কিন্তু কতদিন তথাকার করগ্রাহী ছিলেন ? এবারও জয় করিলে, এবারও তাহা ঘটিবে । না হয়, আবার সৈন্য প্রেরণ করিবেন ; আবার উৎকল জয় করুন, আবার পাঠান স্বাধীন হইবে । পাঠানেরা বাঙ্গালী নহে ; কখনও অধীনতা স্বীকার করে নাই ; এক জন মাত্র জীবিত থাকিতে কখন করিবেও ন!, ইহা নিশ্চিত কহিলাম। তবে আর. রাজপুত পাঠানের শোণিতে পৃথিবী প্লাবিত করিয়া কাজ কি ?” জগতসিংঙ্গ কহিলেন, “আপনি কিরূপ করিতে বলেন ?” ওসমান কহিলেন, “আমি কিছুষ্ট বলিতেছি না। আমার প্রভু সন্ধি করিতে বলেন ।” জ। কিরূপ সন্ধি ? ও । উভয় পক্ষেই কিঞ্চিৎ লাঘব স্বীকার করুন, নবাব কতলুগ বাহুবলে বঙ্গদেশের যে অংশ জয় করিয়াছেন, তাহ ত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছেন । আকৃবর শাহও উড়িষ্যার স্বত্ব ত্যাগ করিয়া সৈন্স লইয়। যাউন, আর ভবিষ্যতে আক্রমণ করিতে ক্ষান্ত থাকুন । ইহাতে বাদশাহের কোন ক্ষতি নাই ; বরং পাঠানের ক্ষতি । আমরা যাহ! (ক্লশে হস্তগত করিয়াছি, তাহা ত্যাগ করিতেছি ; আকৃবর শাহু সাহ হ্ৰস্তগত করিতে পারেন নাই, তাহাই ত্যাগ করিতেছেন । রাজকুমার শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “উত্তম কথা ; কিন্তু এ সকল প্রস্তাব আমার নিকট কেন ? সন্ধিবিগ্রহের কৰ্ত্ত মহারাজ মানসিংহ ; তাহার নিকট দূত প্রেরণ করুন ।” ওসমান’কহিলেন, “মহারাজের নিকট দূত প্রেরণ করা হুইয়াছিল ; দুর্ভাগ্যবশতঃ তাহার নিকট কে রটনা করিয়াছে যে, পাঠানের মহাশয়ের প্রাণহানি করিয়াছে । মহারাজ সেই শোকে ও ক্রোধে সন্ধির নামও শ্রবণ করিলেন না ; দূতের কথায় বিশ্বাস করিলেন না ; যদি মহাশয় স্বয়ং সন্ধির প্রস্তাবকর্তা হয়েন, তবে তিনি সন্মত হইতে পরিবেন ।” রাজপুত্র ওসমানের প্রতি পুনৰ্ব্বার স্থিরদৃষ্টি করিয়া কহিলেন;--- “সকল কথ। পরিষ্কার করিয়া বলুন । আমার হস্তাক্ষর প্রেরণ করিলেও মহারাজের প্রতীতি জন্মিবার সম্ভাবন । তবে আমাকে স্বয়ং যাইতে কেন কহিতেছেন ?”