পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ফুর্গেশনন্দিনী হৃদয়ের তাপ কখনও তোমার নিকট প্রকাশ পাইত না, কখনও মনুষ্যকর্ণগোচর হইত না ।" রাজপুত্র নিঃশব্দে দাড়াইয়া রহিয়াছেন ; অন্তঃকরণ সন্তাপে দগ্ধ হইতেছিল । ওসমানও কথা কহিলেন না । আয়েষ! আবার বলিতে লাগিলেন, “ওসমান, আবার বলি, যদি দোষ করিয়া থাকি, দোষ মার্জন করিও ! আমি তোমার পূৰ্ব্বমত স্নেহপরায়ণ ভগিনী ; ভগিনী বলিয়৷ তুমিও পূৰ্ব্বস্নেহের লাঘব করিও না। কপালের দোষে সন্তাপ-সাগরে ঝাপ দিয়াছি, ভ্রাতৃস্নেহে নিরাশ করিয়। আমায় অতল জলে ডুবাইও ন৷ ” এই বলিয়া সুন্দরী, দাসীর প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা না করিয়৷ একাকিনী বহির্গত হইলেন । ওসমান কিয়ৎক্ষণ বিহবলের দ্যায় বিনাবাক্যে থাকিয়, নিজ মন্দিরে প্রস্থান করিলেন । ষোড়শ পরিচ্ছেদ দাসী চরণে সেই রজনীতে কতলু থার বিলাস গৃহমধ্যে নৃত্যু হইতেছিল। তথায় অপর নৰ্ত্তকী কেহ ছিল ন!— বা অপর শ্রোতা কেহ ছিল না । জন্মদিনোপলক্ষে মোগল সম্রাটের যেরূপ পারিষদমণ্ডলীমধ্যে আমোদপরায়ণ থাকিতেন, কতলু খার সেরূপ ছিল না । কতলু খাঁর চিত্ত একান্ত আত্মস্থখরত, ইন্দ্রিয়তৃপ্তির অভিলাষী । অদ্য রাত্রে তিনি একাকী নিজ বিলাস গৃহ-নিবাসিনীগণে পরিবেষ্টিত হইয়া তাহাদিগের নৃত্যগীত কৌতুকে মন্ত ছিলেন । খোজাগণ ব্যতীত অন্ত পুরুষ তথায় আসিবার অনুমতি ছিল না । রমণীগণ কেহ নাচিতেছে, কেহ গায়িতেছে, কেহু বাদ্য করিতেছে ; অপর সকলে কতল গাকে বেষ্টন করিয়া বসিয়া শুনিতেছে। ইন্দ্রিয়মুগ্ধকর সামগ্ৰী সকলই তথায় প্রচুর পরি মাণে বর্তমান । কক্ষমধ্যে প্রবেশ কর ; প্রবেশ করিবামাত্র অবিরত সিঞ্চিত গন্ধবারির স্নিগ্ধ ঘ্ৰাণে আপাদমস্তক শীতল হয়। অগণিত রজত দ্বিরদরদ স্ফটিক শামাদানের তীব্রোজ্জল জালা নয়ন ঝলসিতে ছিল ; অপরিমিত পুষ্পরাশি কোথাও মালাকারে, কোথাও স্ত,পাকারে, কোথাও স্তবকাকারে, কোথাও রমণীকেশপাশে, কোথাও রমণীকণ্ঠে স্নিগ্ধতর প্রভা প্রকাশিত করিতেছে । কাহারও পুষ্পব্যজন ; কাজারও পুষ্প আভরণ ; কেহ বা অঙ্গের প্রতি ونه পুপক্ষেপণী প্রেরণ করিতেছে ; পুষ্পের সৌরভ, সুরভি বারির সৌরভ, সুগন্ধ দীপের সৌরভ, গন্ধ । দ্রব্যমার্জিত বিলাসিনীগণের অঙ্গের সৌরভ, পুরীমধ্যে সৰ্ব্বত্র সৌরভে ব্যাপ্ত। প্রদীপের দীপ্তি, পুপের । দীপ্তি, রমণীগণের রত্নালঙ্কারের দীপ্তি, সৰ্ব্বোপরি ঘন ঘন কটাক্ষবর্ষিণী কামিনীমণ্ডলীর উজ্জল নয়নদীপ্তি। সপ্তস্বরসম্মিলিত মধুর বীণাদি বাদ্যের ধ্বনি আকাশ ব্যাপিয়া উঠিতেছে, তদধিক পরিষ্কার মধুরনিনাদিনী রমণীকণ্ঠগীতি তাহার সহিত মিশিয়া উঠিতেছে ; সঙ্গে সঙ্গে তালতয়মিলিত পাদৰিক্ষেপে নর্তকীর অলঙ্কার শিঞ্জিত মন মুগ্ধ করিতেছে। ঐ দেখ পাঠক ! যেন পদ্মবনে হংসী সমীরণোখিত তরঙ্গহিল্লোলে মাটিতেছে ; প্রফুল্ল পদ্মমুখী সবে ঘেরিয়া রহিয়াছে । দেখ, দেখ, ঐ যে সুন্দরী নীলাম্বর- • পরিধান, ঐ যার নীলবাস স্বর্ণতারাবলীতে খচিত, দেখ ! ঐ যে দেখিতেছ, সুন্দর সীমান্তপার্থে হীরকতারা ধারণ করিয়াছে, দেখিয়াছ, উহার কি সুন্দর ললাট ! প্রশাস্ত, প্রশস্ত, পরিষ্কার ; এ ললাটে কি বিধাত বিলাসগৃহ লিখিযাছিলেন ? ঐ যে শু্যাম৷ পুষ্পাভরণ, দেখিয়াছ, উহার কেমন পুষ্পাভরণ সাজিয়াছে ? নারীদেই শোভার জন্যই পুষ্প-স্মৃষ্টিf হইয়াছিল । ঐ যে দেখিতেছ, সম্পূর্ণ, মূহুরক্ত, ওষ্ঠাধুর যার ; যে ওষ্ঠাধর ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া রহিয়াছে, দেখ, উহার সুচিকণ নীলবাস ফুটিয়া কেমন বর্ণপ্রভা বাহির হইতেছে ; যেন নিৰ্ম্মল নীলাম্বুমধ্যে পূর্ণচন্দ্রা লোক দেখা যাইতেছে । এই যে সুন্দরী মরালনিন্দিত, গ্রীবাভঙ্গী করিয়া হাসিয়। হাসিয়া কথা কহিতেছে, দেখিয়াছ, উহার কেমন কর্ণের কুণ্ডল দুলিতেছে ? কে তুমি সুকেশি সুন্দরি ? কেন উরঃপর্য্যস্ত কুঞ্চিতালকরাশি লম্বিত করিয়৷ দিয়াছ ? পদ্মবক্ষে কেমন করিয়৷ কাল ফণিনী জড়ায়, তাহাই কি দেখাইতেছ? আর, তুমি কে সুন্দরি, যে কতলু খার পাশ্বে বসিয়া হৈমপাত্রে সুরা ঢালিতেছ ? কে তুমি, ষে সকল রাখিয়া তোমার পূর্ণ লাবণ্য দেহ প্রতি কতলু খা ঘন ঘন সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতেছে ? কে তুমি, অব্যর্থ কটাক্ষে কতলু খাঁর হৃদয় ভেদ করিতেছ? ও মধুর কটাক্ষ চিনি ! তুমি বিমল । অত সুর ঢালিতেছ কেন ? ঢাল, ঢাল, আরও ঢাল, বসনমধ্যে ছুরিক আছে ত? আছে বৈ কি। তবে অত হাসিতেছ কিরূপে ? কতলু খাঁ তোমার মুখপানে: চাহিতেছে ! ও কি ? কটাক্ষ ! ও কি আবার্টু কি ? ঐ দেখ, মুরাস্বাদ-প্রমত্ত যবনকে ক্ষিপ্ত করিলে : এই কৌশলেই বুঝি সকলকে বর্জিত করিয়া శ్యా