পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

3. se নবম পরিচ্ছেদ সেই অবধি নিত্য কলসী-কক্ষে রোহিণী বারুণী পুষ্করিণীতে জল আনিতে যায়, নিত্য কোকিল ডাকে, নিত্য সেই গোবিন্দলালকে পুষ্পকাননমধ্যে দেখিতে পায়, নিত্য সুমতি কুমতিতে সন্ধি-বিগ্ৰহ উভয় ঘটন। श्शू ! সুমতি কুমতির বিবাদ বিসংবাদ মনুষ্যের গছনীয় ; কিন্তু সুমতি কুমতির সদ্ভাব অতিশয় বিপত্তি জনক। তখন স্বমতি কুমতির ভাব ধারণ করে, কুমতি সুমতির কাজ করে। তখন কে স্বমতি, কে কুমতি, চিনিতে পারা যায় না । লোকে সুমতি বলিয়। কুমতির বশ হয় । যাহা হউক, কুমতি হউক, সুমতি হউক, গোবিন্দ লালের রূপ রোহিণীর হৃদয়পটে দিন দিন গাঢ়তর বর্ণে অঙ্কিত করিতে লাগিল। অন্ধকার চিত্রপট-—উজ্জ্বল চিত্র। দিন দিন চিত্র উজ্জলতর, চিত্ৰপট গাঢ়তর • অন্ধকার হইতে লাগিল । তখন সংসার তাহার চক্ষে, —যাক্ পুরাতন কথা আমার তুলিয়া কাজ নাই । রোহিণীর মনে স্থান পাইয়াছিল । রোহিণী সহসা গোবিন্দলালের প্রতি মনে মনে অতি গোপনে প্রণয়াসক্ত হইল । কুমতির পুনৰ্ব্বার জয় হইল । কেন যে এত কালের পর তাহার এ দুর্দশ হইল, তাহা আমি বুঝিতে পারি না এবং বুঝাইতেও পারি ল। এই রোহিণী গোবিন্দলালকে বালককাল হইতে দেখিতেছে—কখনও তাহার প্রতি রোহিণীর চিত্ত আক্লষ্ট হয় নাই । আজি হঠাৎ কেন ? জানি না । যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহ। তাহ বলিয়াছি । সেই দুষ্ট কোকিলের ডাকাডাকি, সেই বাপী তীরে রোদন, সেই কাল, সেই স্থান, সেই চিত্তভাব, তাহার পর গোবিন্দলালের অসময়ে করুণা—আবার গোবিন্দ লালের প্রতি রোহিণীর বিনাপরাধে অঙ্গায়াচরণ, এই সকল উপলক্ষে কিছুকাল ব্যাপিয়া গোবিন্দলাল তাহাতে কি হয় না হয়, তাহা আমি জানি না, যেমন ঘটিয়াছে, আমি তেমনই লিখিতেছি । রোহিণী অতি বুদ্ধিমতী, একেবারেই বুঝিল যে, মরিবার কথা। যদি গোবিন্দলাল ঘুর্ণাক্ষরে এ কথা জানিতে পারে, তবে কখনও তাহার ছায়া মাড়াইবে না । হয় ত গ্রামের বাহির করিয়া দিবে। কাহারও কাছে এ কথা বলিবার নহে । রোহিণী অতি যত্নে মনের কথা মনে লুকাইয়া রাখিল । কিন্তু যেমন লুক্কায়িত অগ্নি ভিতর হইতে দগ্ধ করিয়া আইসে, রোহিণীর চিত্ত তাহাই হইতে লাগিল । বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী জীবনভার বহন করা রোহিণীর পক্ষে কষ্টদায়ক হইল । রোহিণী মনে মনে রাত্রদিন মৃত্যুকামনা করিতে লাগিল । কত লোকে যে মনে মনে মৃত্যুকামনা করে, কে তাহার সংখ্যা রাখে ? আমার বোধ হয়, যাহারা স্বর্থী, যাহারা দুঃখী, তাহাদের মধ্যে অনেকেই কায়মনোবাক্যে মৃত্যুকামনা করে। এ পৃথিবীর মুখ সুখ নহে, সুখও দুঃখময়, কোন সুখেই সুখ নাই, কোনও সুখই সম্পূর্ণ নহে, এই জন্য অনেক স্বর্থী জনে মৃত্যুকামনা করে—আর দুঃখী, দুঃখের ভার আর বহিতে পারে না বলিয়া মৃত্যুকে ডাকে। মুতুকে ডাকে, কিন্তু কার কাছে মৃত্যু আসে ? ডাকিলে মৃত্যু আসে না। যে মুখী, যে মরিতে চায় না, ধে সুন্দর, যে সুর, যে আশাপূর্ণ, যাহার চক্ষে পৃথিবী নন্দনকানন, মৃত্যু তাহারই কাছে আসে । রোহিণীর মত কাহারও কাছে আসে না । এ দিকে মন্ত্রব্যের এমনি শক্তি অল্প যে, মৃত্যুকে ডাকিয়া আনিতে পারে না। একটি ক্ষুদ্র স্টাবেধে, অৰ্দ্ধবিন্দু ঔষধভক্ষণ এ নশ্বর জীবন বিনষ্ট হইতে পারে, এ চঞ্চল জীবনবিস্ব কলসাগরে মিলাইতে পারে—কিন্তু আন্তরিক মৃত্যুকামনা করিলেও প্রায় কেহ ইচ্ছাপূৰ্ব্বক সে স্থচ ফুটায় না, সে অৰ্দ্ধবিন্দু ঔষধ পান করে ন। কেহ কেহ তাহ পারে কিন্তু রোহিণী সে দলের নহে—রোহিণী তাহ পারিল না । কিন্তু এক বিষয়ে রোহিণী কৃতসঙ্কল্প হইল—জাল উইল চালান হইবে না । ইহার এক সহজ উপায় ছিল—কৃষ্ণকান্তকে বলিলে, কি কাহারও স্বারা বলাইলেষ্ট হইল বে মহাশয়ের উইল চুরি গিয়াছে—দেরাজ পুলিয়। যে উইল আছে, তাহা পড়িয়া দেখুন। রোহিণী যে চুরি করিয়াছিল, ইহাও প্রকাশ করিবার প্রয়োজন নাই—যেই চুরি করুক, কৃষ্ণকাস্তের মনে একবার সন্দেহমাত্র জন্মিলে, তিনি সিন্দুক খুলিয়া উইল পড়িয়া দেখিবেন, তাহা হইলে জাল উইল দেখিয়া নূতন উইল প্রস্তুত করিবেন । গোবিন্দ্রলালের সম্পত্তি রক্ষা হইবে অথচ কেহ জানিতে পারবে না যে, কে উইল চুরি করিয়াছিল! কিন্তু ইহাতে এক বিপদ-কৃষ্ণকান্ত জলি উইল পড়িলেই জানিতে পারিবেন যে, ইহা ব্ৰহ্মানন্দের হাতের লেখা –তখন ব্ৰহ্মানন্দ মহা বিপদে পড়িবেন । অতএব দেরাজে যে জাল উইল আছে, ইহা কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ করা যাইতে পারে না। অতএব হরলালের লোভে রোহিণী গোবিনালালের যে গুরুতর অনিষ্ট সিদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, তৎ প্রতীকারার্থ-বিশেষ ব্যাকুলা হইয়াও সে খুল্লতাতের