রাজসিংহ এক জন বহুসংখ্যক রাজপুতের আক্রমণে নিপাত যাইতেছিল। শেষ দুই চারি জন মাত্র অবশিষ্ট ছিল । দূর হইতে ইহা দেখিতে পাইয়া মাণিকলাল সেখানে শীঘ্রই উপস্থিত হইলেন । রাজপুতদিগকে ডাকিয়া তিনি বলিলেন, “ইহাদিগকে মারিও না । ইহার বীরপুরুষ । ইহাদিগকে ছাড়িয়া দাও।” রাজপুতের মুহূৰ্ত্ত জন্য নিরস্ত হইল । তখন মাণিকলাল বলিল, “তোমরা চলিয়! যাও । তোমাদের ছাড়িয়া দিলাম । আমার অনুরোধে কেহ তোমাদের কিছু বলিবে না।” 粤 এক জন মোগল বলিল, “আমরা যুদ্ধে কখন পিছন ফিরি নাই । আজও ফিরিব না ।” সেই কয় জন মোগল আবার যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। তখন মাণিকলাল মবারককে ডাকিয় বলিলেন, “খ সাহেব, আর যুদ্ধ করিয়! কি করিবে ?” মবারক বলিল, “মরিব ” মাণিক । কেন মরিবে ? মবা । আপনি কি জানেন না ষে, মৃত্যু ভিন্ন আমার অন্য গতি নাই ? মাণিক। তবে বিবাহ করিলেন কেন ? মব । মরিবার জন্ত । এই সময়ে একটা বন্দুকের শব্দ পৰ্ব্বতে পৰ্ব্বতে প্রতিধ্বনিত হুইল । প্রতিধ্বনি কর্ণে প্রবেশ করিতে না করিতে মবারক মস্তকে বিদ্ধ হইয়া ভূতলশাস্ত্রী হইলেন। মাণিকলাল দেখিলেন, মবারক জীবনশূন্য। মাথায় গুলী বিধিয়াছে । মাণিকলাল চাহিয়া দেখিলেন, পৰ্ব্বতের সামুদেশে এক জন স্ত্রীলোক বন্দুক হাতে দাড়াইয়া আছে । তাহার বন্দুকের মুখনিঃস্থত ধুম দেখা গেল । বলা বাহুল্য, সে উন্মাদিনী দরিয়া । মাণিকলাল স্ত্রীলোককে ধরিতে আজ্ঞা দিলেন। সে হাসিতে হাসিতে পলাইয়া গেল । সেই অবধি বিবিকে পৃথিবীতে আর কেহ কখন দেখে I যুদ্ধের পর জেব-উন্নিসা শুনিল, মবারক যুদ্ধে মরিয়াছে । তখন সে বেশভুষা দুরে নিক্ষেপ করিল, উদয়সাগরের প্রস্তরকঠিন ভূমির উপর পড়িয়া কাদিল— "বসুধালিঙ্গনধুসরস্তনী বিললাপ বিকীর্ণমুর্বজ৷ ” க_. ষোড়শ পরিচ্ছেদ পূর্ণাহুতি—ইষ্টলাভ যুদ্ধাস্তে জয়ন্ত্র বহন করিয়া বিক্রম সোলাঙ্কি রাজসিংহের শিবিরে ফিরিয়া আসিলেন । রাজসিংহ তাহাকে সাদরে আলিঙ্গন করিলেন । বিক্রম সোলাঙ্কি বলিলেন, “একটা কথা বাকি আছে । আমার সেই কন্যাট । কায়ুমনোবাক্যে আশীৰ্ব্বাদ করিয়া আপনাকে সেই কন্যা সম্প্রদান করিতে ইচ্ছা করি । গ্রহণ করিবেন কি ?” রাজসিংহ বলিলেন, “তবে উদয়পুরে চলুন।” বিক্রম সোলাঙ্কি সেই দুই সহস্ৰ ফোঁজ লইয়া উদয়পুরে গেলেন । বলা বাহুল্য, সেই রাত্রেই রাজসিংহ চঞ্চলকুমারীর পাণিগ্রহণ করিলেন । তার পর যা ঘটিল, তাহাতে ইতিহাসবেত্তারই অধিকার, উপন্যাসলেখকের সে সৰ কথা বলিবার প্রয়োজন নাই । আবার স্বয়ং ঔরঙ্গজেব রাজসিংহের সর্বনাশ করিতে প্রস্তুত হইলেন । আঞ্জিম আসিয়া ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে মিলিত হইয়াছিল । রাজসিংহ বিখ্যাত মাড়বারী দুর্গাদাসের সঙ্গে মিলিত হইয়া, ঔরঙ্গজেবকে আক্রমণ করিলেন । ঔরঙ্গজেব পুনশ্চ পরাজিত ও অপমানিত হইয়া বেত্ৰাহত কুকুরের ন্যায় পলায়ন করিলেন । রাজপুতের তাহার সর্বস্ব লুঠিয়া লইল । ঔরঙ্গজেবের বিস্তর সেনা মরিল ৷ ঔরঙ্গজেব ও আজিম ভয়ে পলাইয়া রাণাদিগের পরিত্যক্ত রাজধানী চিতেীরে গিয়া আশ্রয় লইলেন । কিন্তু সেখানেও রক্ষা নাই। সুবলদাস নাম এক জন রাজপুত সেনাপতি পশ্চাতে গিয়া চিতোর ও আজমীরের মধ্যে সেন স্থাপন করিলেন । আবার আহারবন্ধের ভয় । অতএব খাঁ রহিলাকে বারো হাজার ফৌজের সহিত সুবলদাসের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পাঠাইয়া দিয়া ঔরঙ্গজেব স্বয়ং আজমীরে পলায়ন করিলেন । আর কখনও উদয়পুরমুখ হইলেন না। সে সাধ তাহার জন্মের মত ফুরাইল । এ দিকে সুবলদাস খাঁ রহিলাকে উত্তমমধ্যম দিয়া দুীকৃত করিলেন। পরাভূত হইয়া খাঁ রহিলাও আজমীরে প্রস্থান করিলেন । দিগন্তরে রাজসিংহের দ্বিতীয় পুত্র কুমার ভীমসিংহ গুজরাট অঞ্চলে মোগলের অধিকারে প্রবেশ করিয়া সমস্ত নগর, গ্রাম, এমন কি, মোগল সুবাদারের রাজধানীও করিলেন ; অনেক স্থান অধিকার করিয়া সৌরাষ্ট্র
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১০৪
অবয়ব