পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

. 8 - :- ३ि . `r..: | | ή মোল্লার এত সাহসের কারণু এই যে, কিনারা অতি নিকট । অবিলম্বেই কিনারায় নৌকা লাগিল । তখন নাবিকের নামিয়া নৌকা কাছি করিল। বোধ হয়, রহমৎ মোল্লার সঙ্গে দেবতার কিছু বিবাদ ছিল, ঝড় কিছু গুরুতর বেগে আসিল । ঝড় আগে আসিল । ঝড় ক্ষণেককাল গাছপালার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করিয়া সহোদর বৃষ্টিকে ডাকিয়া আনিল । তখন দুই ভাই বড় মাতামাতি আরম্ভ করিল । ভাই বৃষ্টি, ভাই ঝড়ের কাধে চড়িয়া উড়িতে লাগিল। দুই ভাই গাছের মাথা ধরিয়া নেওয়ায়, ডাল ভাঙ্গে, লতা ছেড়ে, ফুল লোফে, নদীর জল উড়ায়, নানা উৎপাত করে। এক ভাই রহমৎ মোল্লার টুপি উড়াইয়া লইয়া গেল, আর এক ভাই তাহার দাড়িতে প্রস্রবণের স্বজন করিল। দাড়ীর পাল মুড়ি দিয়া বসিল । বাবু সব সার্স ফেলিয়া দিলেন। ভূত্যের নৌকাসজ্জা সকল রক্ষা করিতে লাগিল । নগেন্দ্র বিষম সঙ্কটে পড়িলেন । নৌকা হইতে ঝড়ের ভয়ে নামিলে নাবিকেরা কাপুরুষ মনে করিবে —না নামিলে স্বৰ্য্যমুখীর কাছে মিথ্যাবাদী হইতে হয় । কেহ কেহ জিজ্ঞাসা করিবেন, “তাহাতেই ব৷ ক্ষতি কি ?” আমরা জানি না, কিন্তু নগেন্দ্র ক্ষতি বিবেচনা করিতেছিলেন । এমন সময়ে রহমৎ মোল্লা স্বয়ং বলিল যে, “হুজুর, পুরাতন কাছি, কি জানি কি হয়, ঝড় বড় বাড়িল, নৌকা হইতে নামিলে ভাল হুইত " সুতরাং নগেন্দ্র নামিলেন । নিরাশ্রয় নদীতীরে ঝড়-বৃষ্টিতে দাড়ান কাহারও মুসাধ্য নহে, বিশেষ সন্ধ্যা হইল, ঝড় থামিল না, সুতরাং আশ্রয়ানুসন্ধানে যাওয়া কৰ্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া নগেন্দ্র গ্রামাভিমুখে চলিলেন । নদীতীর হইতে গ্রাম কিছু দূরবর্তী ; নগেন্দ্র পদব্ৰজে কর্দমময় পথে চলিলেন । বৃষ্টি থামিল, ঝড়ও অল্পমাত্র রহিল ; কিন্তু আকাশ মেঘপরিপূর্ণ। সুতরাং রাত্রে আবার ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা । নগেন্দ্র চলিলেন, ফিরিলেন না । আকাশে মেঘাড়ম্বর কারণ রাত্রি প্রদোষকালেই স্বনান্ধতমোময়ী হুইল । গ্রাম, গৃহ, প্রান্তর, পথ, নদী, কিছুই লক্ষ্য হয় না । কেবল বনবিটপী সকল, সহস্ৰ সহস্র খদ্যোতমালা পরিমণ্ডিত হইয় হীরকখচিত কৃত্রিম বৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতেছিল । কেবলমাত্র গর্জনবিরত শ্বেতকৃষ্ণাভ মেঘমালার মধ্যে হ্রস্বর্দীপ্তি সৌদামিনী মধ্যে মধ্যে চমকিতেছিল—স্ত্রীলোকের ক্রোধ একেবারে হ্রাস প্রাপ্ত হয় না । কেবলমাত্র নববারিসমাগম প্রফুল্ল ভেকের উৎসব করিতেছিল। ঝিল্লীরব মনোযোগ পূর্বক লক্ষ্য করলে শুনা যায়, عدة ة • রাবণের চিতার স্থায় অশ্রান্ত রব করিতেছে, কিন্তু বিশেষ মনোযোগ না করিলে লক্ষ্য হয় না । শব্দের মধ্যে বৃক্ষাগ্র হইতে বৃক্ষপন্ধুের উপর বর্ষাবশিষ্ট বারিবিন্দুর পতনশব, বৃক্ষতলস্থ বর্ষাজলে পত্ৰচুত জলবিন্দুপতনশব্দ, পথিস্থ নিঃস্থতজলে শৃগালের পদসঞ্চারণ-শব্দ, কদাচিৎ বৃক্ষারূঢ় পক্ষীর আর্দ্র পক্ষের জলমোচনার্থ পক্ষবিধুননশব্দ, মধ্যে মধ্যে শমিতপ্রায় বায়ুর ক্ষণিক গর্জন, তৎসঙ্গে বৃক্ষপত্রচু্যত বারিবিন্দুসকলের এককালীন পতনশবদ । ক্রমে নগেন্দ্র দূরে একটা আলো দেখিতে পাইলেন। জলপ্লাবিত ভূমি অতিক্রম করিয়া, বৃক্ষচ্যুত বারি কর্তৃক সিক্ত হইয়া, বৃক্ষতলস্থ শৃগালের ভীতি-বিধান করিয়া নগেন্দ্র সেই আলোকাভিমুখে চলিলেন। বহুকষ্টে আলোকসন্নিধি উপস্থিত হইলেন ; দেখিলেন, এক ইষ্টকনিৰ্ম্মিত প্রাচীন বাসগৃহ হইতে আলো নির্গত হইতেছে । গৃহের দ্বার মুক্ত । নগেন্দ্র ভৃত্যকে বাহিরে রাখিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, গৃহের অবস্থা ভয়ানক । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দীপনির্বাণ গৃহটি নিতান্ত সামান্ত নহে। কিন্তু এখন তাহাতে সম্পদূলক্ষণ কিছুই নাই। প্রকোষ্ঠ সকল ভগ্ন, মলিন, মনুষ্যসমাগম চিহ্ন-বিরহিত । কেবলমাত্র পেচক, মুষিক ও নানাবিধ কীটপতঙ্গাদি সমাকীর্ণ। একটিমাত্র কক্ষে আলো জলিতেছিল। সেই কক্ষমধ্যে নগেন্দ্র প্রবেশ করিলেন । দেখিলেন, কক্ষমধ্যে মনুষ্যজীবনোপযোগী দুই একটা সামগ্ৰী আছে মাত্র, কিন্তু সে সকল সামগ্ৰী দারিদ্র্যব্যঞ্জক । দুই একটা হঁাড়ি—একটা ভাঙ্গা উনান, তিন চারিখান তৈজস— ইহাই গৃহালঙ্কার । দেওয়ালে কালী, কোণে বুলি ; চারিদিকে আরমুলা, মাকড়সা, টিকটিকি, ইন্দুর বেড়াইতেছে । এক ছিন্ন শয্যায় এক জন প্রাচীন শয়ন করিয়া আছেন। দেখিয়া ৰোধ হয়, তাহার অন্তিম কাল উপস্থিত । চক্ষু মান, নিশ্বাস প্রখর, ওষ্ঠ কম্পিত । শষ্যাপার্থে গৃহচ্যুত ইষ্টকখণ্ডের উপর একটি মৃন্ময় প্রদীপ, তাহাতে ভৈলাভাৰ ; শয্যোপরিস্থ জীবনপ্রদীপেও তাহাই । আর শষ্যাপাশ্বেও অার এক প্রদীপ ছিল,—এক অনিন্দিত গৌরকাস্তি স্নিগ্ধজ্যোতিৰ্ম্ময়রূপিণী বালিকা । তৈলহীন প্রদীপের জ্যোভিঃ অপ্রখর বলিয়াই হউক, অথবা গৃহবাসী দুই জন আগু ভাৰী বিরহের