পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবৃক্ষ ভাৰিতেছেন? এইরূপ —“ভাল, সবাই আগে মলে৷ —ম মলো, দাদা মলো, ৰাবা মলো, আমি মলেম না কেন ? যদি না মলেম ত এখানে এলাম কেন ? ভাল, মানুষ কি মরিয়া নক্ষত্র হয় ?” পিতার পরলোকযাত্রার রাত্রে কুন্দ যে স্বপ্ন দেখিয়াছিল, কুনোর আর তাহা কিছুই মনে ছিল না ; কখনও মনে হইত না, এখনও তাহ মনে হইল না । কেবল আভাসমাত্র মনে আসিল । এইমাত্র মনে হইল, যেন সে কবে মাতাকে স্বপ্নে দেখিয়াছিল, তাহার মা যেন তাহাকে নক্ষত্র হইতে বলিয়াছেন। কুন্দ ভাবিতে লাগিল, ভাল, মানুষ মরিলে কি নক্ষত্র হয় ? তা হ’লে ত বাবা, মা, সবাই নক্ষত্র হইয়াছেন ? তবে তার কোন নক্ষত্র গুলি ? ঐট ? না ঐট ? কোনটি কে ? কেমন করিয়া জানিব ? তা যেটিই যিনি হউন, অামায় ত দেখতে পেতেছেন ? আমি যে এত কঁাদি তা দূর হউক, ও আর ভাবিব না—বড় কান্ন পায় । কেঁদে কি হবে ? অামার ত কপালে কান্নাই আছে—নহিলে মা—আবার ঐ কথা ! দূর হউক—ভাল, মরিলে হয় না ? কেমন করিয়া ? জলে ডুবিয়া ? বেশ ত! মরিলে নক্ষত্র হব—তা হ'লে হব ত? দেখিতে পাব-রোজ রোজ দেখিতে পাব –কাকে ? মুখে বলিতে পারিনে কি ? আচ্ছা, নাম মুখে আনিতে পারিনে কেন ? এখন ত কেহ নাই, কেহ শুনিতে পাবে না। একবার মুখে আনিব ? কেহ নাই— মনের সাধে নাম করি । ন—নগ—নগেন্দ্র । নগেন্দ্র নগেন্দ্র, নগেন্দ্র, নগেন্দ্র, নগেন্দ্র । নগেন্দ্র, অামার নগেন্দ্ৰ ! আলো ! আমার নগেন্দ্র ? আমি কে ? স্বৰ্য্যমুখীর নগেন্দ্র । কতই নাম করিতেছি—হ'লেম কি ? আচ্ছ, স্বৰ্য্যমুখীর সঙ্গে বিয়ে না হয়ে যদি আমার সঙ্গে হতো–দূর হউক! ডুবেই মরি। আচ্ছ, যেন এখন ডুবিলাম, কা’ল ভেসে উঠবে। —তবে সবাই শুনূবে, শুনে নগেন্দ্র –নগেন্দ্র । — নগেন্দ্র l-নগেন্দ্ৰ ! আবার বলি-নগেন্দ্র, নগেন্দ্র নগেন্দ্র –নগেঞ্জ শুনে কি বলিবেন ? ডুবে মরা হবে না-ফুলে পড়িয়া থাকিব—দেখিতে রাক্ষপীর মত হব । যদি তিনি দেখেন ? বিষ খেয়ে ত মরিতে পারি ? কি বিষ খাব ? বিষ কোথা পাব—কে আমায় এনে দিবে ? দিলে যেন—মরিতে পারিব কি ? পারি-কিন্তু আজি না—একবার আকাঙ্ক্ষণ ভরিয়া মনে করি—তিনি আমায়ু ভালবাসেন । কমল কি কথাটা বলুতে বলতে বলিল না ? সে ঐ কথাই । আfচ্ছ, সে কথা কি সভ্য ? কিন্তু কমল জানিৰে কিসে? আমি পোড়ারমুখী জিজ্ঞাসা করিতে २१ , পারিলাম না। ভালবাসেন ? কিসে ভালবাসেনী, কি দেখে ভালবাসেন, রূপ ন গুণ ? রূপ--দেখি ? ( এই কহিয়া কালামুখী স্বচ্ছ সরোবরে আপনার প্রতিবিম্ব দেখিতে গেল, কিন্তু কিছুই দেখিতে না , পাইয়া আবার পূৰ্ব্বস্থানে আসিয়া বসিল । ) “দুর হউক, যা নয়, তা ভাবি কেন ? আমার চেয়ে স্বৰ্য্যমুখী স্বন্দর ; আমার চেয়ে হরমণি সুন্দর ; বিশু সুন্দর ; মুক্ত সুন্দর ; চন্দ্র সুন্দর ; প্রসন্ন সুন্দর ; বাম সুন্দর ; প্রমদ সুন্দর ; আমার চেয়ে হীরা দাসীও সুন্দরী । হীরাও আমার চেয়ে সুন্দর ? “হা, খামবর্ণ হ’লে কি হয়—মুখ আমার চেয়ে মুনীর। তা রূপ ত গোল্লাই গেল–গুণ কি ? আচ্ছা, দেখি, দেখি ভেবে । কই, মনে ত হয় না । কে জানে ' কিন্তু মরা হবে না ; ঐ কথা ভাবি । মিছে কথা । তা মিছে কথাই ভাবি । মিছে কথাকে সত্য করিয়া ভাবিব, কিন্তু কলিকাতায় যেতে হবে যে, তা ত যেতে পারিব না ; দেখিতে পাব না যে, আমি যেতে পাবৃত্বঃ না-পারব না—পারব না। তা না গিয়াই বা কি করি ? যদি কমলের কথা সত্য হয়, তবে ত যারা আমার জন্য এত করেছে, তাদের ত সৰ্ব্বনাশ করিতেছি । স্বৰ্য্যমুখীর মনে কিছু হয়েছে বুঝিতে পারি । সত্যই হউক, মিথ্যাই হউক, কাজে কাজেই আমায় যেতে হবে। তা পারিব না। তাই ডুবে মরি। মরিবই মরিব । বাবা গে ! তুমি কি আমাকে ডুবির মরিবার জন্য রাখিয়া গিয়াছিলে ?-- কুন্দ তখন দুই চক্ষে হাত দিয়া কাদিতে লাগিল । সহসা অন্ধকার গৃহে প্রদীপ জালার ন্যায়, কুনের সেই স্বপ্ন বৃত্তান্ত স্বম্পষ্ট মনে পড়িল । কুন্দ তখন বিদ্যুৎপৃষ্ঠার স্তায় গাত্ৰোখান করিল । “আমি সকল ভুলিয়া গিয়াছি-আমি কেন ভুললাম ! ম আমাকে দেখা দিয়াছিলেন-মা আমার কপালের লিখন জানিতে পারিয়া আমায় ঐ নক্ষত্ৰলোকে যাইতে বলিয়াছিলেন -আমি কেন তার কথা শুনলেম না-- আমি কেন গেলাম না ! আমি কেন মলাম না ! আমি এখনও বিলম্ব করিতেছি কেন ? আমি এখনও মরিতেছি না কেন ? আমি এখনই মরিব ” এই ভাবিয়া কুন্দ ধীরে ধীরে সেই সরোবরসোপান অবতরণ আরম্ভ করিল । কুন্দ নিস্তান্ত অবলা -নিতান্ত ভীরুস্বভাবাপন্ন। —প্রতি পদার্পণে ভয় পাইতেছিল— প্রতি পদার্পণে তাহার অঙ্গ শিহরিতেছিল। তথাপি, অশ্বলিত সঙ্কল্পে সে মাতার আজ্ঞাপালনার্থ ধীরে ধীরে যাইতেছিল। এমন সময়ে পশ্চাৎ হইতে কে অক্তি ধীরে ধীরে তাহার পৃষ্ঠে অঙ্গুলিস্পর্শ করিল। ৰলি;