পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবৃক্ষ উনপঞ্চাশত্তম পরিচ্ছেদ এত দিনে মুখ ফুটিল কুন্দনন্দিনী খাঁটের বাজুতে মাথা রাখিয়া, ভূতলে বসিয়াছিল—লগেন্দ্রকে নিকটে আসিতে দেখিয়া তাহার চক্ষুর জল আপনি উছলিয়া উঠিল। নগেন্দ্র নিকটে দাড়াইলে, কুনা ছিন্নবল্পীবৎ তাহার পদপ্রান্তে মাথা লুটাইয়া পড়িল। নগেন্দ্র গদগদকণ্ঠে কহিলেন, “এ কি এ কুনা ! তুমি কি দোষে আমায় ত্যাগ করিয়া যাইতেছ?” - কুন্দ কখন স্বামীর কথার উত্তর করিত না— আজি সে অস্তিমকালে মুক্তকণ্ঠে স্বামীর সঙ্গে কথা কহিল—বলিল, “তুমি কি দোযে আমাকে ত্যাগ করিয়াছ ?” - নগেন্দ্র তখন নিরুত্তর হইয়া, অধোবদনে কুন্দনন্দিনীর নিকটে বসিলেন। কুন্দ তখন আবার কহিল, “কাল যদি তুমি আসিয়া এমনি করিয়া একবার কুন্দ বলিয়া ডাকিতে,—কাল যদি একবার আমার নিকটে এমনি করিয়া বসিতে—তবে আমি মরিতাম না। আমি অল্পদিনমাত্র তোমাকে পাইয়াছি —তোমাকে দেখিয়া আমার আজিও তৃপ্তি হয় নাই। আমি মরিতাম না ।” এই প্রতিপূর্ণ শেলসম কথা শুনিয়া নগেন্দ্র জাম্বর উপর ললাট রক্ষা করিয়া, নীরবে রহিলেন। তখন কুনা আবার কহিল,—কুন আজি বড় মুখর, সে আর ত স্বামীর সঙ্গে কথা কহিবার দিন পাইবে না–কুন্দ কহিল, “ছি! তুমি আমন করিয়া নীরব হইয়া থাকিও না। আমি তোমার হাসিমুখ দেখিতে দেখিতে যদি না মরিলাম—তবে অামার মরণেও সুখ নাই ।” স্বৰ্য্যমুখীও এইরূপ কথা বলিয়াছিলেন ; অস্তকালে সবাই সমান । - নগেন্দ্র তখন মৰ্ম্মপীড়িত হইয়া কাতর স্বরে কহিলেন, “কেন তুমি এমন কাজ করিলে ? তুমি আমায় একবার কেন ডাকিলে না ?” কুন্দ, বিলম্নভূয়িষ্ঠ জলদাস্তব্বৰ্ত্তিনী বিদ্যুতের ন্যায় স্বল্পমধুর দিব্য হাসি হাসিয়া কহিল, “তাহা ভাবিও না। যাহা বলিলাম, তাহা কেবল মনের আবেগে বলিয়াছি । তোমার আসিবার আগেই আমি মনে স্থির করিয়াছিলাম যে, তোমাকে দেখিয়া মরিব । মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম যে, দিদি যদি কখনও ফিরিয়া আসেন, তবে তাহার কাছে তোমাকে রাখিয়া আমি ૧ (t মরিব-আর তাহার মুখের পথে কাটা হইয়া থাকিৰ না। আমি মরিব বলিয়াই স্থির করিয়াছিলামতবে তোমাকে দেখিলে আমার মরিতে ইচ্ছা করে না ।” নগেন্দ্র কোন উত্তর করিতে পারিলেন না । আজি তিনি বালিকা অবাকৃপটু কুন্দনন্দিনীর নিকট নিরুত্তর হইলেন । - কুন্দ ক্ষণকাল নীরব হইয়া রহিল। তাহার কথা কহিবার শক্তি অপনীত হইতেছিল। মৃত্যু তাহাকে অধিকৃত করিতেছিল । নগেন্দ্র তখন, সেই মৃত্যুচ্ছায়ান্ধকার মান মুখমণ্ডলের স্নেহ-প্রফুল্লতা দেখিতেছিলেন । তাহার সেই আধিক্লিষ্ট মুখে মন্দবিদ্যুন্নিন্দিত ষে হাসি তখন দেখিয়াছিলেন, নগেন্দ্রের প্রাচীন বয়স পর্য্যস্ত তাহL হৃদয়ে অঙ্কিত ছিল । কুন্দ আবার কিছুকাল বিশ্রামলাভ করিয়া, অপরিতৃপ্তের ন্যায় পুনরপি ক্লিষ্ট নিশ্বাসসহকারে কহিতে লাগিল, “আমার কথা কহিবার তৃষ্ণ নিবারণ হইল না—আমি তোমাকে দেবতা বলিয়া জানিতামসাহস করিয়া কখনও মুখ ফুটিয়া কথা কহি নাই । আমার সাধ মিটিল না—আমার শরীর অবসন্ন হুইয়া আসিতেছে—আমার মুখ শুকাইতেছে—জিব টানিতেছে—আমার আর বিলম্ব নাই।” এই বলিয়া কুন্দ পৰ্য্যঙ্কাবলম্বন ত্যাগ করিয়া, ভূমে শয়ন করিয়া, নগেন্দ্রের অঙ্কে মাথা রাখিল এবং নয়ন মুদ্রিত করিয়া নীরব হইল । ডাক্তার আসিল । দেখিয়া শুনিয়া ঔষধ দিল না—আর ভরসা নাই দেখিয়া মানমুখে প্রত্যাবর্তন করিল। পরে সময় আসন্ন বুঝিয়া, কুন্দ স্বৰ্য্যমুখী ও কমলমণিকে দেখিতে চাহিল। র্তাহারা উভয়ে আসিলে, কুন্দ তাহাদের পদধূলি গ্রহণ করিল। তাহারা উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিলেন । - তখন কুন্দনন্দিনী স্বামীর পদযুগলমধ্যে মুখ লুকাইল । তাহাকে নীরব দেখিয়া দুই জনে আবার উচ্চৈঃস্বরে কাদিয়া উঠিলেন। কিন্তু কুন্দ আর কথা কহিল না । ক্রমে ক্রমে চৈতন্যভ্রষ্টা হইয়া, চরণমধ্যে - মুখ রাথিয়া, নবীন যৌবনে কুন্দনন্দিনী প্রাণত্যাগ: করিল ! অপরিস্ফুট কুন্দকুসুম শুকাইল । * প্রথম রোদন সংবরণ করিয়া স্বৰ্য্যমুখী মৃত সপত্নী প্রতি চাহিয়া বলিলেন, “ভাগ্যবতি ! তোমার মত; প্রসন্ন অদৃষ্ট আমার হউক। আমি যেন এইরূপে স্বামীর চরণে মাথা রাখিয়া প্রাণত্যাগ করি।” ' '