পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১২ হে। মৃণালিনী কেমন আছে ? গি। দেখিলাম, শরীরে কোন পীড়া নাই । হে । সুখে আছে কি ক্লেশে আছে—কি বুঝিলে ? গি । শরীরে গহনা, পরণে ভাল কাপড়— হৃষীকেশ ব্রাহ্মণের কন্যার সই । হে। তুমি অধঃপাতে যাও ; মনের কথা কিছু বুঝিলে ? গি। বর্ষাকালের পদ্মের মত ; মুখখানি কেবল জলে ভাসিতেছে । হে। পরন্থহে কি ভাবে আছে ? গি । এই অশোক-ফুলের স্তবকের মত। আপনার গৌরবে আপনি নম । হে । গিরিজায় ! তুমি বয়সে বালিকা মাত্র। তোমার দ্যায় বালিকা আর দেখি নাই । গি । মাথা ভাঙ্গিবার উপযুক্ত পাত্রও এমন আর দেখেন নাই । ছে । সে অপরাধ লইও না । মৃণালিনী আর কি বলিল ? গি । ষে দিন জানকী— ছে । আবার ? গি। ষো দিন জানকী, রঘুবীর নিরথি— হেমচন্দ্র গিরিজায়ার কেশাকর্ষণ করিলেন । তখন সে কহিল, *ছাড় ! ছাড়! বলি—বলি * “বল” বলিয়া হেমচন্দ্র কেশ ত্যাগ করিলেন । তখন গিরিজায়া আদ্যোপাস্ত মৃণালিনীর সহিত কথোপকথন বিবৃত করিল । পরে কহিল,— “মহাশয় । আপনি যদি মৃণালিনীকে দেখিতে চান, তবে আমার সঙ্গে এক প্রহর রাত্রে যাত্রা করিবেন ? গিরিজায়ার কথা সমাপ্ত হইলে, হেমচন্দ্র অনেকক্ষণ নিঃশব্দে অশোকতলে পাদচারণ করিতে লাগিলেন । বহুক্ষণ পরে কিছুমাত্র না বলিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং তথা হইতে একখানি পত্র জানিয়া গিরিজায়ার হস্তে দিলেন এবং কহিলেন, “মৃণালিনীর সহিত সাক্ষাতে আমার এক্ষণে অধিকার নাই । তুমি রাত্রে কথামত র্তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে এবং এই পত্র তাহাকে দিবে। কহিবে, “দেবতা প্রসন্ন হইলে অবশু শীঘ্র বৎসরেকমধ্যে সাক্ষাৎ হক্টৰে ? মৃণালিনী কি বলেন, আজ রাত্রেই আমাকে বলিয়া যাইও " গিরিজায়। বিদায় হইলে, হেমচন্দ্র অনেকক্ষণ চিত্তিতান্তঃকরণে অশোকবৃক্ষতলে তৃণশয্যায় শয়ন বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী করিয়া রছিলেন। ভুজোপরি মস্তক রক্ষা করিয়া পৃথিবীর দিকে মুখ রাখিয়া শয়ান রহিলেন । কিয়ৎকাল পরে সহসা তাহার পৃষ্ঠদেশে কঠিন করম্পর্শ হইল। মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন, সম্মুখে মাধবাচার্য্য । মাধবাচার্য্য কহিলেন, “বৎস! গাত্ৰোখান কর । আমি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছি-সন্তুষ্টও হইয়াছি। তুমি আমাকে দেখিয়া বিন্মিতের স্তায় কেন চাহিয়া রহিয়াছ ?” হেমচন্দ্র কহিলেন, “আপনি এখানে কোথা হইতে আসিলেন ?” মাধবাচার্য্য এ কথার কোন উত্তর না দিয়া কহিতে লাগিলেন, “তুমি এ পর্য্যন্ত নবদ্বীপে না গিয়া পথে বিলম্ব করিতেছ—ইহাতে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছি। আর তুমি যে মৃণালিনীর সন্ধান পাইয়াও আত্মসত্য প্রতিপালনের জন্য র্তাহার সাক্ষাতের সুযোগ উপেক্ষা করিলে, এ জন্য তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছি । তোমাকে কোন তিরস্কার করিব না। কিন্তু এখানে তোমার আর বিলম্ব করা হইবে না। মুণালিনীর প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষা করা হইবে না। বেগবান হৃদয়কে বিশ্বাস নাই । আমি আজি নবদ্বীপে যাত্রা করিব । তোমাকে আমার সঙ্গে যাইতে হুইবে – নৌকা প্রস্তুত আছে। অস্ত্রশস্ত্রাদি গৃহমধ্য হইতে লইয়া আইস । আমার সঙ্গে চল ।” হেমচন্দ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “হানি নাই—আমি আশা-ভরসা বিসর্জন করিয়াছি। চলুন। কিন্তু আপনি—কামচর না অন্তৰ্য্যামী ?” এই বলিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে পুনঃপ্রবেশপূৰ্ব্বক বণিকের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন, এবং আপনার সম্পত্তি এক জন বাহকের স্কন্ধে দিয়া আচার্য্যের অমুবৰ্ত্তী হইলেন । পঞ্চম পরিচ্ছেদ লুব্ধ মৃণালিনী বা গিরিজায়া এতন্মধ্যে কেহই আত্মপ্রতিশ্রুতি বিস্তুত হইলেন না। উভয়ে প্রহরেক রাত্রিতে হৃষীকেশের গৃহপাশ্বে সম্মিলিত হইলেন । মৃণালিনী গিরিজায়াকে দেখিবামাত্র কহিলেন,-“কৈ, হেমচন্দ্র কোথায় ?” গিরিজায়া কহিল, “তিনি আইসেন নাই ।”