مواج অভিমানপ্রযুক্ত ভৃত্যের আলাপ গ্রহণ করেন না। এ জন্য স্বয়ং তৎসম্ভাষণে গেলেন। ব্রাহ্মণকে প্রণাম করিলেন। জনাৰ্দ্দন আশীৰ্ব্বাদ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তুমি কে ?” হেম । আমি আপনার তৃত্য । জ। কি বলিলে—তোমার নাম রামকৃষ্ণ ? হেমচন্দ্র অনুভব করিলেন, ব্রাহ্মণের শ্রবণশক্তি ৰড় প্রবল নহে। অতএব উচ্চতরস্বরে কহিলেন, *আমার নাম হেমচন্দ্র । আমি ব্রাহ্মণের দাস /* জ। ভাল ভাল ; প্রথমে ভাল শুনিতে পাই নাই, তোমার নাম হনুমানদাস । হেমচন্দ্র মনে করিলেন, “নামের কথা দূর হউক ; কাৰ্য্যসাধন হইলেই হইল।” বলিলেন,"নবদ্বীপাধিপতির এই অট্টালিকা, তিনি ইহা আমার বাসের জন্য নিযুক্ত করিয়াছেন । শুনিলাম, আমার আসায় আপনি স্থানত্যাগ করিতেছেন।” জ। না, এখনও গঙ্গাস্বানে ষাই নাই ; এই স্নানের উদ্যোগ করিতেছি । হে । ( অত্যুচ্চৈঃস্বরে ) স্নান যথাসময়ে করিবেন। এক্ষণে আমি এই অনুরোধ করিতে আসিয়াছি যে, আপনি এ গৃহ ছাড়িয়া যাইবেন না । জ। গৃহে আহার করিব না ? তোমার বাটতে কি ? আদ্যশ্ৰাদ্ধ ? হে । ভাল, আহারাদির অভিলাষ করেন, তাহারও উদ্যোগ হইবে । এক্ষণে যেরূপ এ বাটতে অবস্থিতি করিতেছেন, সেইরূপই করুন। জ। ভাল ভাল ; ব্রাহ্মণভোজন করাইলে দক্ষিণা ত আছেই । তা বলিতে হইবে না । তোমার বাড়ী কোথ। । হেমচন্দ্র হতাশ্বাস হুইয়া প্রত্যাবর্তন করিতেছিলেন, এমন সময়ে পশ্চাৎ হইতে কে র্তাহার উত্তরীয় ধরিয়া টানিল । হেমচন্দ্র ফিরিয়৷ দেখিলেন । দেখিয়া প্রথম মুহূর্তে র্তাহার বোধ হইল, সম্মুখে একখানি কুসুমনিৰ্ম্মিত দেবীপ্রতিমা । দ্বিতীয় মুহুর্তে দেখলেন, প্রতিমা সঙ্গীব ; তৃতীয় মুহূর্তে দেখিলেন, প্রতিমা নহে, বিধাতার নিৰ্ম্মাণ-কৌশল-সীমা-রূপিণী বালিক অথবা পুর্ণযৌবনা তরুণী । বালিকা না তরুণী ? ইহা হেমচন্দ্র তাহাকে দেখিয়া নিশ্চিত করিতে পারিলেন না । বীণানিন্দিতস্বরে সুন্দরী কহিলেন, “তুমি পিতামহকে কি বলিতেছিলে ? তোমার কথা উনি শুনিতে পাইবেন কেন ?” ৰঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী হেমচন্দ্ৰ কহিলেন, “তাহা ত পাইলেন না দেখিলাম। তুমি কে ?” বালিকা বলিল, “আমি মনোরমা ।” হে । ইনি তোমার পিতামহ ? মনো। তুমি পিতামহকে কি বলিতেছিলে ? হে । শুনিলাম, ইনি এ গৃহ ত্যাগ করিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন। আমি তাই নিবারণ করিতে আসিয়াছি । মনে । এ গৃহে এক রাজপুত্র আসিয়াছেন । তিনি আমাদিগকে থাকিতে দিবেন কেন ? হে । আমিই সেই রাজপুত্র। আমি তোমা দিগকে অনুরোধ করিতেছি, তোমরা এখানে থাক । ম। কেন ? এ 'কেন'র উত্তর নাই। হেমচন্দ্র অন্ত উত্তর না পাইয়া কহিলেন, “কেন ? মনে কর, যদি তোমার ভাই আসিয়া এই গৃহে বাস করিত, সে কি তোমাদিগকে তাড়াইয়া দিত ?” ম। তুমি কি আমার ভাই ? হে । আজি হইতে তোমার ভাই হইলাম । এখন বুঝিলে ? ম। বুঝিয়াছি । কিন্তু ভগিনী বলিয়া আমাকে কখন তিরস্কার করিবে না ত ? হেমচন্দ্র মনোরমার কথার প্রণালীতে চমৎকৃত হইতে লাগিলেন । ভাবিলেন, "এ কি অলৌকিক সরল বালিকা ? না উন্মাদিন ?” কহিলেন, "কেন তিরস্কার করিব ?” ম। যদি আমি দোষ করি ? হে । দোষ দেখিলে কে না তিরস্কার করে ? মনোরম ক্ষুণ্ণভাবে দাড়াইয়া রহিলেন ; বলিলেন, “আমি কখন ভাই দেখি নাই ; ভাইকে কি লজ্জা করিতে হয় ?” হে । না । ম। তবে আমি তোমাকে লজ্জা করিব নাতুমি আমাকে লজ্জা করিবে ? হেমচন্দ্র হাসিলেন—কহিলেন, “আমার বক্তব্য তোমার পিতামহকে জানাইতে পারিলাম না,— ভাহার উপায় কি ?” ম। আমি বলিতেছি। এই বলিয়া মনোরম। মৃদু মৃদু স্বরে জনাৰ্দ্দনের নিকট হেমচন্দ্রের অভিপ্রায় জানাইলেন। হেমচন্দ্র দেখিয়া বিক্ষিত হইলেন যে, মনোরমার সেই স্বছ কথা বধিরের বোধগম্য হুইল ।
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২১৩
অবয়ব