পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মৃণালিনী 8X * হেমচন্দ্র পথিপার্শ্বস্থ এক ক্ষুদ্র বৃক্ষের শাখা ভগ্ন করিয়া হস্তে লইয়া কহিলেন, “দুর হ, নচেৎ বেত্ৰাঘাত করিব ।” গিরিজায়ার আর সহ্য হইল না । ধীরে ধীরে বলিল, “বীরপুরুষ বটে ! এই রকম বীরত্ব প্রকাশ করিতে বুঝি নদীয়ায় এসেছ ? কিছু প্রয়োজন ছিল না—এ বীরত্ব মগধে বসিয়াও দেখাইতে পারিতে । মুসলমানের জুতা বহিতে, আর গরীব-দুঃখীর মেয়ে দেখিলে বেত মারিতে ।” হেমচন্দ্র অপ্রতিভ হইয়। বেত ফেলিয়! দিলেন । কিন্তু গিরিজায়ার রাগ গেল না । বলিল, “তুমি মৃণালিনীকে বিবাহ করিবে ? মৃণালিনী দূরে থাক, তুমি আমারও যোগ্য নও।” এই বলিয়া গিরিজায়, সদৰ্পে গজেন্দ্রগমনে চলিয়া গেল । হেমচন্দ্র ভিখারিণীর গৰ্ব্ব দেখিয়া অবাকৃ झंझेब्र রছিলেন। গিরিজায় প্রত্যাগত হইয়। হেমচন্দ্রের আচরণ মৃণালিনীর নিকট সবিশেষ বিবৃত করিল । এবার কিছু লুকাইল না । মৃণালিনী শুনিয়া কোন উত্তর করিলেন না । রোদনও করিলেন না। যেরূপ অবস্থায় শ্রবণ করিতেছিলেন, সেইরূপ অবস্থাতেই রহিলেন । দেখিয়া গিরিজায়া শঙ্কান্বিত হইল— তখন মৃণালিনীর কথোপকথনের সময় নহে বুঝিয়া তথা হইতে সরিষা গেল । পাটনীর গৃহের অনতিদূরে যে এক সোপানবিশিষ্ট পুষ্করিণী ছিল, তথায় গিয়া গিরিজায়া সোপানোপরি উপবেশন করিল। শারদীয়া পূর্ণিমার প্রদীপ্ত কৌমুদীতে পুষ্করিণীর স্বচ্ছ নীলাম্বু অধিকতর নীলোজল হইয়া প্রভাসিত হইতেছিল। তদুপরি স্পন্দনরহিত কুসুমশ্রেণী অৰ্দ্ধপ্রস্ফুটিত হইয়া নীল জলে প্রতিবিম্বিত হইয়াছিল ; চারিদিকে বৃক্ষমাল নিঃশব্দে পরস্পরশ্লিষ্ট হইয়া আকাশের সীমা নির্দেশ করিতেছিল ; কচিৎ দুই একটি দীর্ঘ শাখা উৰ্দ্ধোথিত হইয়। আকাশপটে চিত্রিত হইয়া রহিয়াছিল। তলস্থ অন্ধকারপুঞ্জ হইতে নবন্মুটকুস্বমসৌরভ আসিতেছিল । গিরিজায় সোপানোপরি উপবেশন করিল। গিরিজায় প্রথমে ধীরে ধীরে, মৃদু মৃদু গীত আরম্ভ করিল—যেন নবশিক্ষিতা বিহঙ্গী প্রথমোদ্যমে স্পষ্ট গান করিতে পারিতেছে না । ক্রমে তাহার স্বর স্পষ্টতালাভ করিতে লাগিল—ক্রমে ক্রমে উচ্চতর হইতে লাগিল, শেষে সেই সৰ্ব্বাঙ্গ-সম্পূর্ণতানলয়বিশিষ্ট কমনীয় কণ্ঠধবনি পুষ্করিণী, উপবন, আকাশ বিপ্লুত করিয়া স্বৰ্গচ্যুত স্বরসরিক্তরঙ্গস্বরূপ মৃণালিনীর কর্ণে - প্রবেশ করিতে লাগিল । গিরিজায়া গায়িল ঃ–

  • পরাণ না গেলো । ষো দিন পেখমু সই যমুনাকি তীরে, গায়ত নাচত সুন্দর ধীরে ধীরে, ওঁহি পর পিয় সই, কাহে কালে নীরে, জীবন না গেলো ? ফিরি ঘর আয়নু, না কহনু বোলি, তিতায় আঁখিনীরে আপনা আঁচলি, রোই রোই পিয় সই কাহে লে। পরাণি তইখন না গেলে ? শুনন্ত শ্রবণ-পথে মধুর বাজে, রাধে রাধে রাধে রাধে বিপিনমাঝে, যব শুনন্‌ লাগি সই, সে মধুর বোলি,

জীবন না গেলো ? বায়ুনু পিয় সই, সোহি উপকূলে, লুটায়ুনু কাদি সই খামপদমূলে, সোহি পদমূলে রই, কাহে লো হামারি মরণ না ভেলো ?” গিরিজায়৷ গায়িতে গায়িতে দেখিলেন, তাহার সম্মুখে চন্দ্রের কিরণোপরি মনুষের ছায়া পড়িয়াছে। ফিরিয়া দেখিলেন, মৃণালিনী দাড়াইয়া আছেন। র্তাহার মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিলেন, মৃণালিনী । কাদিতেছেন । ! গিরিজায়া দেখিয়া হর্ষান্বিত হইলেন,—তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, যখন মৃণালিনীর চক্ষুতে জল আসিয়াছে—তখন র্তাহার ক্লেশের কিছু শমত। হইয়াছে। ইহা সকলে বুঝে নী—মনে করে, “কৈ, ইহার চক্ষুতে ত জল দেখিলাম না, তবে ইহার কিসের দুঃখ ?” যদি ইহা সকলে বুঝিত, সংসারের কত মৰ্ম্মপীড়াই না জানি নিবারণ হইত । কিয়ৎক্ষণ উভয়েই নীরব হইয়া রহিল। মৃণালিনী কিছু বলিতে পারেন না ; গিরিজায়াও কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারে না । পরে মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়া, আর একবার তোমাকে যাইতে হুইবে ।” গি । আবার সে পাষণ্ডের নিকট যাইব কেন ? মৃ ৷ পাষণ্ড বলিও না । হেমচন্দ্র ভ্রান্ত হইয়া থাকিবেন—এ সংসারে অভ্রান্ত কে ? কিন্তু হেমচন্দ্র - পাষণ্ড নহেন। আমি স্বয়ং তাহার নিকট এখনই । যাইব—তুমি সঙ্গে চল । তুমি আমাকে ভগিনীর । অধিক স্নেহ কর—তুমি আমার জন্ত না করিরাছ কি ? . তুমি কখনও আমাকে অকারণে মনঃপীড়া দিবে না