পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ পারিতেছি না। আমি মরিলে সে মরিবে । আমাকে মারিতে হয়, আগে তাহাকে মারুন " দম্য র্কাদিতে লাগিল, পরে চক্ষুর জল মুছিয়া বলিতে লাগিল, “মহারাজাধিরাজ ! আমি আপনার পাদম্পর্শ করিয়া শপথ করিতেছি, আর কখনও দস্থ্যত করিব না। চিরকাল আপনার দাসত্ব করিব ৷ আর যদি জীবন থাকে, এক দিন না এক দিন এ ক্ষুদ্র ভূত্য হইতে উপকার হইবে ।” রাজপুত বলিলেন, “তুমি আমাকে চেন ?” দক্ষ্য বলিল, “মহারাণী রাজসিংহকে কে না চিনে ?” o তখন রাজসিংহ বলিলেন, “আমি তোমার জীবন দান করিলাম । কিন্তু তুমি ব্রাহ্মণের ব্রহ্মস্ব হরণ করিয়াছ, আমি যদি তোমাকে কোন প্রকার দণ্ড নী দিই, তবে আমি রাজধৰ্ম্মে পতিত হইব ।” মাণিকলাল বিনীতভাবে বলিল, “মহারাজাধিরাজ ! এ পাপে আমি নুতন ব্রতী। অনুগ্রহ করিয়া আমার প্রতি লঘু দণ্ডেরই বিধান করুন। আমি আপনার সম্মুখেই শাস্তি লইতেছি।” এই বলিয়া দম্য কটিদেশ হইতে ক্ষুদ্র ছুরিকা নির্গত করিয়া, অবলীলাক্রমে আপনার তর্জনী অঙ্গুলী ছেদন করিতে উদ্যত হইল। ছুরিতে মাংস কাটিয়া, অস্থি কাটিল না । তখন মাণিকলাল এক শিলাখণ্ডের উপর হস্ত রাখিয়া ঐ অঙ্গুলীর উপর ছুরিকা বসাইয়। আর এক খণ্ড প্রস্তরের দ্বারা তাহাতে ঘ মারিল । আঙ্গুল কাটিয়া মাটীতে পড়িল। দস্থ্য বলিল, “মহারাজ ! এই দণ্ড মঞ্জুর করুন।” রাজসিংহ দেখিয়া বিস্মিত হইলেন, দম্য ক্ৰক্ষেপও করিতেছে না । বলিলেন, “ইহাই যথেষ্ট, তোমার নাম কি ?” দস্থ্য বলিল, “এ অধমের নাম মাণিকলাল সিংহ । আমি রাজপুতকুলের কলঙ্ক ৷” রাজসিংহ বলিলেন, “মাণিকলাল, আজি হইতে তুমি আমার কার্য্যে নিযুক্ত হইলে, এক্ষণে তুমি অশ্বারোহী সৈন্তভুক্ত হইলে—তোমার কন্যা লইয়। —উদয়পুরে যাও, তোমাকে ভূমি দিব, বাস করিও ।” মাণিকলাল তখন রাণার পদধূলি গ্রহণ করিল এবং রাণাকে ক্ষণকাল অৰস্থিতি করাইয়া গুহামধ্যে প্রবেশ করিয়া তথা হইতে অপহৃত মুক্তাবলয়, পত্র দুইখানি এবং আসরফি চারি ভাগ আনিয়া দিল। বলিল,-“ব্রাহ্মণের ষাহা আমরা কাড়িয়া লইয়াছিলাম, তাহ ঐচরণে অর্পণ করিতেছি । পত্র २8s দুইখানি আপনারই জন্য। দাস যে উহ! পাঠ করিয়াছে, সে অপরাধ মার্জন করিবেন ।” রাণা পত্র হস্তে লইয়া দেখিলেন, তাহারই নামাঙ্কিত শিরোনামা । বলিলেন, “মাণিকলাল—পত্র পড়িবার এ স্থান নহে । আমার সঙ্গে আইস– তোমরা পথ জানো, পথ দেখাও।” মাণিকলাল পথ দেখাইয়া চলিল। রাণা দেখিলেন যে, দক্ষ্য একবারও তাহার ক্ষত বা আহত হস্তের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেছে না-বা তৎসম্বন্ধে একটি কথাও বলিতেছে না—বা একবার মুখ বিকৃত করিতেছে ন । রাণা শীঘ্রই বন হইতে বেগবতী ক্ষীণ তটিনীতীরে এক সুরমা নিভৃত স্থানে আসিয়৷ উপস্থিত হইলেন । পঞ্চম পরিচ্ছেদ চঞ্চলকুমারীর পত্র তথায় উপলঘাতিনী কলনাদিনী তটিনীরব সঙ্গে স্বমন্দ মধুর বায়ু এবং স্বরলহরীবিকীর্ণকারী কুঞ্জবিহঙ্গম গণ ধ্বনি মিশাইতেছে। তথায় স্তবকে স্তবকে বল্প-কুমুম সকল প্রস্ফুটিত হইয়া পাৰ্ব্বতীয় বৃক্ষরাজি আলোকময় করিতেছে। তথায় রূপ উছলিতেছে, শব্দ তরঙ্গায়িত হইতেছে, গন্ধ মাতিয়া উঠিতেছে এবং মন প্রকৃতির বশীভূত হইতেছে । সেইখানে রাজসিংহ এক বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের উপর উপবেশন করিয়া পত্র দুইখানি পড়িতে প্রবৃত্ত হইলেন । প্রথম রাজা বিক্রমসিংহের পত্র পড়িলেন। পড়িয়া ছিড়িয়া ফেলিলেন-মনে করিলেন, ব্রাহ্মণকে কিছু দিলেই পত্রের উদেশ্ব সফল হইবে । তার পর চঞ্চলকুমারীর পত্র পড়িতে লাগিলেন। পত্র এইরূপ-- “রাজনৃ—আপনি রাজপুতকুলের চুড়া-হিন্দুর শিরোভূষণ । আমি অপরিচিত হীনমতি বালিকা— নিতান্ত বিপন্ন না হইলে কখনই আপনাকে পত্র লিখিতে সাহস করিতাম না। নিতান্ত বিপন্ন বুঝিয়াই আমার এ দুঃসাহস মার্জনা করিবেন। “যিনি এই পত্র লইয়া যাইতেছেন, তিনি আমার গুরুদেব। র্তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে জানিতে পরিবেন—আমি রাজপুতকন্ত । রূপনগর অতি. ক্ষুদ্র রাজ্য, তথাপি বিক্রমসিংহ সোলাঙ্কি রাজপুত— রাজকন্যা বলিয়া আমি মধ্যদেশাধিপতির কাছে গণ্য ন হই-রাজপুতকস্তা বলিয়া দয়ার পাত্রী। কেন না, : আপনি রাজপুতপতি—রাজপুতকুলতিলক । ,