পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ রাজসিংহ দেখিলেন, আর কোনমতেই রক্ষা নাই । তাহার সৈন্তের বিশগুণ সেনা, পথের দুই মুখ বন্ধ করিয়াছে—পথাস্তর নাই—কেবল যমমন্দিরের পথ খোলা। রাজসিংহ স্থির করিলেন, সেই পথে যাইবেন । তখন সৈনিকগণকে একত্র করিয়া বলিতে লাগিলেন—“ভাই বন্ধু, যে কেহ সঙ্গে থাক, আজি সরলান্তঃকরণে আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাহিতেছি । আমারই দোষে এ বিপদ ঘটিয়াছে—পৰ্ব্বত হইতে নামিয়াই এ দোষ করিয়াছি। এখন এই গলির দুই মুখ বন্ধ—দুই মুখেই কামান শুনিতেছি, দুই মুখে আমাদের বিশগুণ মোগল দাড়াইয়া আছে—সন্দেহ নাই। অতএব আমাদিগের বঁাচিবার ভরসা নাই । নাই—তাহাতেই বা ক্ষতি কি ? রাজপুত হইয়া কে মরিতে কাতর ? সকলেই মরিব—এক জনও বাচিব না—কিন্তু মারিয়া মরিব, যে মরিবার আগে দুই জন মোগল না মারিয়া মরিবে—সে রাজপুত নহে। রাজপুতেরা শুন-—এ পথে ঘোড়া ছুটে নী—সবাই ঘোড়া ছাড়িয়া দাও । এসো, আমরা তরবারি হাতে লাফাষ্টয়া গিয়া তোপের উপর পড়ি । তোপ ত আমাদেরই হইবে—তার পর দেখা যাইবে, কত মোগল মারিয়া মরিতে পারি ” তখন রাজপুতগণ, অশ্ব হইতে লাফাইয়া পড়িয়া একত্র অসি নিস্কোষিত করিয়া “মহারাণাকি জয়” বলিয়া দাড়াইল । তাহাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখকাস্তি দেখিয়া রাজসিংহ বুঝিলেন যে, প্রাণরক্ষা না হউক— একটি রাজপুতও হটিবে না। সস্তুষ্টচিত্তে রাণ আজ্ঞা দিলেন, “তুই দুই করিয়া সারি দাও ।” অশ্বপৃষ্ঠে সবে একে একে যাইতেছিল—পদব্রজে তুইয়ে জুইয়ে রাজপুত চলিল—রাণী সৰ্ব্বাগ্ৰে চলিলেন । আজ আসন্নমৃত্যু দেখিয়া তিনি প্রফুল্লচিত্ত । এমন সময়ে সহসা পৰ্ব্বতরঞ্জ কম্পিত করিয়া, পৰ্ব্বতে প্রতিধ্বনি তুলিয়া রাজপুতসেনা শব্দ করিল, “মাতাজীকি জয় । কালীমায়িকি জয় ।” অত্যন্ত হর্ষস্থচক ঘোর রব শুনিয়া রাজসিংহ পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, ব্যাপার কি ? দেখিলেন, দুই পাশ্বে রাজপুতসেনা সারি দিয়াছে--মধ্যে বিশাললোচনা, সহাস্তবদনা, কোন দেবী আসিতেছেন । হয় কোন দেৰী মনুষ্যমূৰ্ত্তি ধারণ করিয়াছেন—নয় কোন মানবীকে বিধাতা দেবীমূৰ্ত্তিতে গঠিয়াছেন— রাজপুতের মনে করিল, চিতোরাধিষ্ঠাত্রী রাজপুতকুলরক্ষিণী ভগবতী এ সঙ্কটে রাজপুতকে রক্ষা করিতে স্বয়ং রণে অবতীর্ণ হইয়াছেন । তাই তাহারা জয়ধ্বনি করিতেছিল। 80 রাজসিংহ দেখিলেন-এ ত মানবী, কিন্তু সামান্ত৷ মানবী নহে। ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ, দোলা, কোথায় ?” এক জন পিছু হইতে বলিল, “দোলা এই দিকে আছে ।” রাণা বলিলেন, “দেখ, দোলা খালি কি না ?” সৈনিক বলিল, “দোলা খালি । কুমারীজী মহারাজের সামনে ৷” চঞ্চলকুমারী তখন রাজসিংহকে প্রণাম করিলেন । রাণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাজকুমারী, আপনি এখানে কেন ?" চঞ্চল বলিলেন, “মহারাজ ! আপনাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছি। প্রণাম করিয়া'ছ—এখন একটি ভিক্ষা চাহি । আমি মুখরা—স্ত্রীলোকের শোভা যে লজ্জা, তাহা অামাতে নাই, ক্ষমা করিবেন । ভিক্ষণ যাহা চাহি –তাহাতে নিরাশ করিবেন न। * চঞ্চলকুমারী হাস্ত ত্যাগ করিয়া ষোড়হাত করিয়া কাতরস্বরে এই কথা বলিলেন । রাজসিংহ বলিলেন, “তোমারই জন্য এতদুর আসিয়াছি—তোমাকে আদেয় কিছুই নাই—কি চাও, রূপনগরের কন্তে ?” চঞ্চলকুমারী আবার যোড়হাত করিয়া বলিল, “আমি চঞ্চলমতি বালিক। বলিয়া আপনাকে আসিতে লিখিয়াছিলাম, কিন্তু আমি নিজের মন আপনি বুঝিতে পারি নাই । আমি এখন মোগল সম্রাটের ঐশ্বৰ্য্যের কথা শুনিয়া বড় মুগ্ধ হইয়াছি । আপনি : অনুমতি করুন-আমি দিল্লী যাইব ।” রাজসিংহ বিস্মিত ও প্রীত হইলেন । বলিলেন, “তোমার দিল্লী যাইতে হয় যাও—আমার আপত্তি নাই । কিন্তু আপাততঃ তুমি যাইতে পাইবে না। যদি এখন তোমাকে ছাড়িয়া দিই, মোগল মনে করিবে যে, প্রাণভয়ে ভীত হইয়া তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম। আগে যুদ্ধ শেষ হউক—তার পর তুমি যাইও । আর তোমার মনের কথা যে বুঝি নাই, তাহা মনে করিও না, আমি জীবিত থাকিতে তোমাকে দিল্লী যাইতে হইবে না। ষোওয়ান্‌ সব— আগে চল ।” তখন চঞ্চলকুমারী মৃদ্ধ হাসিয়া, মৰ্ম্মভেদী মৃদ্ধ কটাক্ষ করিয়া, দক্ষিণহস্তের কনিষ্ঠাঙ্গুলীস্থিত হীরকাজুরীয় বামহস্তের অঙ্গুলীদ্বয়ের দ্বারা ফিরাইয়া রাজসিংহকে দেখাইতে দেখাইতে বলিলেন, “মহারাজ ! এই আঙ্গটিতে বিষ আছে । দিল্লীতে না যাইতে •দিলে, আমি বিষ খাইব r