هما করিলেন। বলিলেন, “তুমি এই সাহসও চাতুর্ঘ্য প্রকাশ করিয়া, মোগল সওদাগর সাজিয়া মোগলসেনা রন্ধ্রপথে না লইয়া গেলে, অনেক প্রাণিহত্যা হইত । তোমাকে কেহ চিনিতে পারিলে তোমারও মহা বিপদ উপস্থিত হুইত ” মবারক বলিল, “মহারাজ ! যে ব্যক্তি সকলের সমক্ষে মরিয়াছে, যাহাকে সকলের সমক্ষে গোর দিয়াছে, তাহাকে কেহ চিনিতে পারিলেও চেনে না —মনে করে, ভ্রম হইতেছে । আমি এই সাহসেই গিয়াছিলাম ” রাজসিংহ বলিলেন, “এক্ষণে যদি আমার কার্য্য সিদ্ধ না হয়, তবে সে আমার দোষ । তুমি ষে পুরস্কার চাহিবে, আমি তাহাই তোমাকে দিব ।” মবারক কহিল, “মহারাজ ! বে-আদবী মাফ ’হৌক । আমি মোগল হইয়া মোগলের রাজ্যধ্বংসের উপায় করিয়া দিয়াছি। আমি মুসলমান হইয়া হিন্দুরাজ্যস্থাপনের কার্য্য করিয়াছি। আমি সত্যবাদী হইয়া মিথ্য প্রবঞ্চনা করিয়াছি । আমি বাদশাহের নেমক খাইয়া নেমকহারামী করিয়াছি । আমি মৃত্যুষন্ত্রণার অধিক কষ্ট পাইতেছি । আমার আর কোন পুরস্কারের সাধ নাই। আমি কেবল এক পুরস্কার আপনার নিকট ভিক্ষা করি। আমাকে তোপের মুখে রাখিয় উড়াইয়া দিবার আদেশ করুন। আমার আর বঁাচিবার ইচ্ছা নাই ।” রাজসিংহ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “যদি এ কাজে তোমার এতই কষ্ট, তবে এমন কাজ কেন করিলে ? আমাকে জানাইলে না কেন ? আমি অন্ত লোক নিযুক্ত করিতাম। আমি কাহাকেও এতদুর মনঃপীড়া দিতে চাহি না ।” মবারক মাণিকলালকে দেখাইয় দিয়া বলিল, “এই মহাত্মা আমার জীবন দান করিয়াছিলেন । ইছার নিতান্ত অনুরোধ যে, আমি এই কাৰ্য্য সিদ্ধ করি । আমি নহিলেও এ কাজ সিদ্ধ হইত না, কেন না, মোগল ভিন্ন হিন্দুকে মোগলের বিশ্বাস করিত না । আমি ইহা অস্বীকার করিলে অকৃতজ্ঞতাপাপে পড়িতাম । তাই এ কাজ করিয়াছি । এক্ষণে এ প্রাণ অার রক্ষা করিব না স্থির করিয়াiছ । আমাকে তোপের মুখে উড়াইয়া দিতে আদেশ করুন । অথবা আমাকে বাধিয়া বাদশাহের নিকট পাঠাইয়া দিন, অথবা অনুমতি দিন যে, আমি যে প্রকারে বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী পারি, মোগল সেনামধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া প্রাণত্যাগ করি ” রাজসিংহ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, *কাল তোমাকে আমি মোগল-সেনায় প্রবেশের অনুমতি দিব । আর এক দিন মাত্র থাক। অামার কেবল এক্ষণে একটা কথা জিজ্ঞাস্ত আছে । ঔরঙ্গজেব তোমাকে বধ করিয়াছিলেন কেন ?” মবারক । তাহা মহারাজের সাক্ষাৎ বক্তব্য নহে । রাজসিংহ । মবারক । বলিয়াছি । রাজসিংহ । আর এক দিন অপেক্ষা কর। এই বলিয়া রাজসিংহ মবারককে বিদায় দিলেন । তার পর মাণিকলাল মবারককে নিভৃতে লইয়। গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সাহেব ! যদি আপনার মরিবার ইচ্ছা, তবে শাহজাদীকে ধরিতে আমাকে অনুরোধ করিয়াছিলেন কেন ?” মবারক বলিল, “ভুল ! সিংহজা, ভুল ! আমি আর শাহজাদা লইয়ু। কি করিব ? মনে করিয়াছিলাম বটে যে, ষে সয়তানী আমার ভালবাসার বিনিময়ে আমাকে কালসাপের ৰিষদস্তে সমর্পণ করিয়া মারিয়াছিল, তাহাকে তাহার কৰ্ম্মের প্রতিফল দিব । কিন্তু মানুষ যাহা অাজ চাহে, কাল তাহার সে ইচ্ছা থাকে না । আমি এখন মরিব নিশ্চয় করিয়াছি -এখন আর শাহজাদী প্রতিফল পাইল না পাইল, তাহাতে আমার কি ? আমি আর কিছুই দেখিতে আসিব ন৷ ” মাণিকলাল। জেব-উন্নিসাকে রাখিতে যদি আপনি অনুমতি না করেন, তবে আমি বাদশাহের নিকট কিছু ঘুষ লইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিই। মবারক । আর একবার তাহাকে আমার দেখিতে ইচ্ছা আছে ৷ একবার জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা আছে যে, জগতে ধৰ্ম্মধৰ্ম্মে তাহার কিছু বিশ্বাস আছে কি না ? একবার শুনিবার ইচ্ছা আছে যে, সে আমায়ু দেখিয়া কি বলে ? একবার জানিবার ইচ্ছা আছে যে, আমাকে দেখিয়া সে কি করে ? মাণিকলাল । তবে আপনি এখনও তাহার প্রতি অনুরক্ত ? মবারক । কিছুমাত্র না । একবার দেখিব মাত্র। আপনার কাছে এই পৰ্য্যস্ত তিক্ষণ । মাণিকলালের সাক্ষাৎ ? _ _
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৮৫
অবয়ব