পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ উদয়পুরের কোটরে মুষিকবৎ পিঞ্জরাবদ্ধ, রূপনগরের ভূঁইঞার মেয়ের বন্দিনী, হিন্দুর ঘরে অস্পৃহা শূকরী, হিন্দু পরিচারিকামণ্ডলীর চরণকলঙ্ককারী কীট ! মরণ কি ইহার অপেক্ষা ভাল নহে! ভাল বৈ কি ! ষে মরণ তিনি প্রাণাধিক প্রিয় মবারককে দিয়াছেন, সে ভাল নয় ত কি ? যা মবারককে দিয়াছেন, তাহা অমূল্য-নিজে কি তিনি সেই মরণের যোগ্য ? হায় মবারক ! মবারক ? মবারক! তোমার অমোঘ বীরত্ব কি সামান্ত ভুজঙ্গমগরলকে জয় করিতে পারিল না ? সে অনিন্দনীয় মনোহর মূৰ্ত্তিও কি সাপের বিযে নীল হইয়া গেল ? এখন উদয়পুরে কি এমন সাপ পাওয়া যায় না যে, এই কালভুজঙ্গীকে দংশন করে ? মামুৰী কালভুজঙ্গী কি ফণিনী কালভুজঙ্গীর দংশনে মরিবে না ? হায় মবারক! মবারক। মবারক! তুমি একবার সশরীর দেখা দিয়’, কালভুজঙ্গী দিয়া আমায় একবার দংশন করাও, আমি মরি কি না দেখ । ঠিক এই কথা ভাবিয়া যেন মবারককে সশরীর দর্শন করিবার মানসেই জেব উন্নিসা নয়ন উন্মলিত করিলেন । দেখিলেন, সম্মুখে সশরীর মবারক । জেব উন্নিসা চাংকার করিয়া, চক্ষু পুনর্নিমালিত করিয়া অজ্ঞান হইলেন । পঞ্চম পরিচ্ছেদ অগ্নিতে ইন্ধনক্ষেপ—জালা বাড়িল পরদিন যখন জেব উন্নিসা শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিলেন, তখন আর র্তাহাকে চেনা যায় না । একে ত পূৰ্ব্বেই মূৰ্ত্তি শীর্ণ, বিবর্ণ, কাদম্বিনীচ্ছায়াপ্রচ্ছন্নাবৎ হইয়াছিল—আজ আরও যেন কি হইয়াছে বোধ হইতে লাগিল । সমস্ত দিনরাত্র আগুনের তাপের নিকট বসিয়া থাকিলে মানুষ যেমন হয়, চিতারোহণ করিয়া, ন পুড়িয়া কেবল ধূম ও তাপে অৰ্দ্ধ দগ্ধা হইয়া চিত হইতে নামিলে যেমন হয়, জেব উন্নিসাকে আজ তেমনই দেখাইতেছিল । জেব-উন্নিসা মুহূৰ্ত্তে মুহূর্তে পুড়িতেছিল । বেশভূষা না করিলে নয় ; জেব উন্নিসা অত্যন্ত অনিচ্ছায় বেশভূষা করিয়া নিয়ম ও অনুরোধ রক্ষার্থ জলযোগ করিল। তার পর প্রথমে উদিপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গেল। দেখিল, উদিপুরী এক বসিয়া আছে-সন্মুখে কুমারী মেরীর প্রতিমূৰ্ত্তি এবং একটি যীশুর ক্রস। অনেক দিন উদিপুরী যীশুকে এবং 南 ના তাহার মাতাকে স্থুলিয়া গিয়াছিলেন । আজ ছুদিনে । তাহাদের ফুল পড়িয়াছিল। খৃষ্টিয়ানীর চিহ্নস্বরূপ এই দুইটি সঙ্গে সঙ্গে ফিরিত ; বৃষ্টির দিনে দুঃখীর পুরাণ ছাতির মত আজ তাহ বাহির হইয়াছিল। জেব উন্নিসা দেখিলেন, উদিপুরীর চক্ষে অবিরল অশ্রদ্ধার ঝরিতেছে—বিন্দুর পশ্চাৎ বিন্দু, বিন্দুর পশ্চাৎ বিন্দু নিঃশব্দে দুগ্ধালক্ৰকনিন্দী গণ্ড যাহিয়৷ ঝরিতেছে । জেব উন্নসা উদিপুরীকে এত সুন্দর কখনও দেখেন নাই । সে স্বভাবতঃ পরম সুন্দরী —কিন্তু গৰ্ব্বে, ভোগবিলাসে, ঈর্ষ্যাদির জালায়, সৰ্ব্বদাই সে অতুল সৌন্দর্ঘ্য একটু বিকৃত হইয়। থাকিত। আজ অশ্রস্রোতে সে বিকৃতি ধুইয়া গিয়াছিল-অপূৰ্ব্ব রূপরাশির পূর্ণবিকাশ হইয়াছিল। উদিপুর জেব উন্নিসাকে দেখিয়া আপনার দুঃখের কথা বলিতেছিলেন । বলিলেন, “আমি বাদী ছিলাম –বাদীর দরে বিক্রীত হইয়াছিলাম—কেন বাদাই রছিলাম না ? কেন আমার কপালে ঐশ্বৰ্য্য ঘটিয়াছিল !—” এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া উদিপুর জেব-উল্লিসার মুখপানে চাহিয়। বলিলেন, “তোমার অবস্থা এমন কেন ? কাল তোমার কি হইয়াছিল ? কাফের তোমার উপরও কি অত্যাচার করিয়াছে ?” জেব উন্নিসা দীর্ঘনিশ্বাস পরিভ্যাগ করিয়া বলিলেন, “কাফেরের সাধ্য কি ? আল্লা করিয়াছেন।” উদিপুরী । সকলই তিনি করেন, কিন্তু কি ঘটিয়াছে, শুনিতে পাই না ? ঞ্জেব। এখন সে কথা মুখে আনিতে পারিব না। মৃত্যুকালে বলিয়া বাইব । উদি। যাই হেীক, ঈশ্বর যেন রাজপুতের এ স্পৰ্দ্ধার দণ্ড করেন। জেব । রাজপুতের ইহাতে কোন দোষ নাই । এই কথা বলিয়। জেব-উন্নিসা নীরব হইয়া রহিল । উদিপুরীও কিছু বলিল না। পরিশেষে চঞ্চলকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার জন্য জেব-উন্নিসা উদিপুরীর নিকট বিদায় চাহিল। উদিপুরী বলিল:"কেন, তোমাকে কি ডাকিয়াছে ?” জেব | ন! | উদি। তবে উপযাচক হইয়া তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না। তুমি বাদশাহের কস্তা । জেব। আমার নিজের বিশেষ প্রয়োজন আছে । উদি। সাক্ষাৎ কর ত জিজ্ঞাসা করিও যে, কত আসরফি পাইলে এই গাওয়ারের আমাদিগকে ছাড়িয়া দিবে ?