পাতা:বঙ্কিম চন্দ্রের দীনবন্ধু-জীবনী.pdf/২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দীনবন্ধু-জীবনী । SS কারণ-এই তত্ত্বটি বুঝান এই সমালোচনার প্রধান উদ্দেশ্য । আমি ইহাও বুঝাইতে চাই, যে যেখানে এই দুইটির মধ্যে একটির অভাব হইয়াছে, সেই খানেই তঁহার কবিত্ব নিস্ফল হইয়াছে । যাহারা তাহার প্রধান নায়ক নায়িকা-( hero এবং heroine ) তাহাদিগের চরিত্র যে তেমন মনোহর হয় নাই, ইহাই তাহার কারণ। আব্দুরী বা তোরাপ জীবন্ত চিত্ৰ, কামিনী বা লীলাবতী, বিজয় বা ললিতমোহন সেরূপ নয়। সহানুভূতি আব্দুরী বা তোরাপের বেলা তাহদের স্বভাব সিদ্ধ ভাষা পৰ্য্যস্ত আনিয়া কবির কলমের আগায় বসাইয়া দিয়াছিল ; কামিনী বা বিজয়ের বেলা, লীলাবতী বা ললিতের বেলা, চরিত্র ও ভাষা উভয় বিকৃত কেন ? যদি তঁহার সহানুভূতি স্বাভাবিক এবং সৰ্ব্বব্যাপী, তবে এখানে সহানুভূতি নিস্ফল কেন ? কথাটা বুঝা সহজ। এখানে অভিজ্ঞতার অভাব । প্ৰথমে নায়িকাদের কথা ধর । লীলাবতী বা কামিনীর শ্রেণীর নায়িকা সম্বন্ধে তাহার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না । ছিল না-কেন না, কোন লীলাবতী বা কামিনী বাঙ্গালা-সমাজে ছিল না । হিন্দুর ঘরে ধেড়ে মেয়ে, কোটশিপের পাত্ৰী হইয়া, যিনি কোটা করিতেছেন, তাহাকে প্ৰাণ মন সমৰ্পণ করিয়া বসিয়া আছে, এমন মেয়ে বাঙ্গালী-সমাজে ছিল না-কেবল আজি কাল নাকি দুই একটা হইতেছে শুনিতেছি । ইংরেজের ঘরে তেমন মেয়ে আছে ; ইংরেজ-কন্যার জীবনই তাই । আমাদিগের দেশের প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থেও তেমনি আছে। দীনবন্ধু ইংরেজি ও সংস্কৃত নাটক নবেল ইত্যাদি পড়িয়া এই ভ্ৰমে পড়িয়াছিলেন যে, বাঙ্গালাকাব্যে বাঙ্গালার সমাজস্থিত নায়ক নায়িকাকেও সেই ছাচে ঢাল চাই । কাজেই যাহা নাই, যাহার আদর্শ সমাজে নাই, তিনি তাই গড়িতে বসিয়াছিলেন । এখন আমি ইহাও বুঝিয়াছি যে, তঁহার চরিত্র-প্ৰণয়ন প্ৰথা এই ছিল যে, জীবন্ত আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া চিত্রকারের ন্যায় চিত্র আকিতেন। এখানে জীবন্ত আদর্শ নাই কাজেই ইংরেজি ও সংস্কৃত গ্রন্থের মধ্যগত মৃৎপুত্তলগুলি দেখিয়া, সে চরিত্র গঠন করিতে হইত। জীবন্ত আদর্শ সম্মুখে নাই, কাজেই সে সৰ্ব্বব্যাপিনী সহানুভূতিও সেখানে নাই। কেন না, সৰ্ব্বব্যাপিনী সহানুভূতিও জীবন্ত ভিন্ন জীবনহীনকে ব্যাপ্ত করিতে পারে না-জীবনহীনের সঙ্গে সহানুভূতির কোন সম্বন্ধ নাই। এখানে পাঠক দেখিলেন যে, দীনবন্ধুর সামাজিক অভিজ্ঞতাও নাই-স্বভাবিক সহানুভূতিও নাই। এই দুইটি লইয়াই দীনবন্ধুর কবিত্ব। কাজেই এখানে কবিত্ব নিস্ফল ।